আসসালামু আলাইকুম, বন্ধুরা! কেমন আছেন সবাই?
আচ্ছা, কখনো কি রাতের আকাশে তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভেবেছেন, তারাগুলো কিভাবে এত আলো ছড়াচ্ছে? অথবা, আমাদের চারপাশের সবকিছু কীভাবে টিকে আছে? এই সবকিছুর পেছনেই কিন্তু বিজ্ঞানের দারুণ সব খেলা লুকিয়ে আছে। আজ আমরা বিজ্ঞানের তেমনই একটা মজার বিষয় নিয়ে কথা বলব – তেজস্ক্রিয়তা।
তেজস্ক্রিয়তা জিনিসটা আসলে কী, কেন এটা ঘটে, আর আমাদের জীবনেই বা এর প্রভাব কী – এইসব কিছু নিয়েই আজকের আলোচনা। তাই, একদম শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকুন!
তেজস্ক্রিয়তা: এক ঝলকে
তেজস্ক্রিয়তা (Radioactivity) হলো কিছু বিশেষ পরমাণুর নিউক্লিয়াসের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভেঙে যাওয়ার প্রক্রিয়া। এই ভাঙনের ফলে নিউক্লিয়াস থেকে বিভিন্ন কণা (যেমন আলফা কণা, বিটা কণা) এবং তেজস্ক্রিয় রশ্মি (গামা রশ্মি) নির্গত হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, কিছু পরমাণু অস্থির প্রকৃতির হয়, এবং স্থিতিশীল হওয়ার জন্য তারা নিজেরাই ভেঙে গিয়ে শক্তি নির্গত করে।
তেজস্ক্রিয়তা কেন হয়?
পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন (ধনাত্মক চার্জযুক্ত) ও নিউট্রন (চার্জবিহীন)। প্রোটনগুলো একে অপরকে বিকর্ষণ করে, কিন্তু নিউক্লিয়াসের ভেতরের একটি শক্তিশালী বল (নিউক্লিয়ার বল) তাদের একত্রে ধরে রাখে। যখন নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা খুব বেশি হয়ে যায়, তখন এই নিউক্লিয়ার বল দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে, নিউক্লিয়াসটি অস্থির হয়ে যায় এবং তেজস্ক্রিয়তা শুরু হয়।
স্থিতিশীলতার খোঁজে: তেজস্ক্রিয়তার মূল কারণ
মনে করুন, আপনি একটি চেয়ারের উপর অনেকগুলো বই স্তূপ করে রেখেছেন। একটা সময় আসবে যখন অতিরিক্ত বইয়ের ভারে স্তূপটি ভেঙে পড়বে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের অবস্থাও অনেকটা তেমনই। অতিরিক্ত প্রোটন এবং নিউট্রন থাকার কারণে নিউক্লিয়াস স্থিতিশীল থাকতে পারে না, তাই তেজস্ক্রিয়তা শুরু হয়।
তেজস্ক্রিয়তার প্রকারভেদ
তেজস্ক্রিয়তা মূলত তিন ধরনের হয়ে থাকে:
-
আলফা (α) ক্ষয়: এই প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস থেকে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন বিশিষ্ট একটি আলফা কণা নির্গত হয়। আলফা কণা অনেকটা হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের মতো।
-
বিটা (β) ক্ষয়: এই প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস থেকে একটি ইলেকট্রন (বিটা কণা) নির্গত হয়। নিউক্লিয়াসের একটি নিউট্রন ভেঙে গিয়ে একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন তৈরি করে।
-
গামা (γ) ক্ষয়: এই প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস থেকে উচ্চ শক্তি সম্পন্ন গামা রশ্মি নির্গত হয়। গামা রশ্মির কোনো ভর বা চার্জ নেই, এটি শুধুমাত্র একটি তাড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ।
তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারের ইতিহাস
তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কার এক মজার গল্প। ১৮৯৬ সালে অঁরি বেকেরেল (Henri Becquerel) নামক একজন ফরাসি বিজ্ঞানী ইউরেনিয়াম নিয়ে কাজ করার সময় প্রথম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। তিনি দেখেন যে ইউরেনিয়াম লবণ থেকে কোনো প্রকার উদ্দীপনা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রশ্মি নির্গত হচ্ছে, যা ফটোগ্রাফিক প্লেটকে আলোড়িত করতে পারে।
মারি কুরি ও পিয়ের কুরি: তেজস্ক্রিয়তার গবেষণায় যুগান্তকারী অবদান
এরপর ম্যারি কুরি (Marie Curie) এবং তাঁর স্বামী পিয়ের কুরি (Pierre Curie) ইউরেনিয়ামের চেয়েও বেশি তেজস্ক্রিয় দুটি নতুন মৌল আবিষ্কার করেন – পোলোনিয়াম (Polonium) এবং রেডিয়াম (Radium)। তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কারের জন্য এই দম্পতি ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। ম্যারি কুরি পরবর্তীতে রেডিয়াম পৃথক করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ১৯১১ সালে রসায়নেও নোবেল পুরস্কার পান।
তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার
তেজস্ক্রিয়তা একদিকে যেমন ক্ষতিকর, তেমনি এর অনেক উপকারী দিকও রয়েছে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:
চিকিৎসা ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তা
- ক্যান্সার চিকিৎসা: তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়। রেডিয়েশন থেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি।
- রোগ নির্ণয়: তেজস্ক্রিয় ট্রেসার ব্যবহার করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ছবি তৈরি করা হয়, যা রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে। যেমন, থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য তেজস্ক্রিয় আয়োডিন ব্যবহার করা হয়।
- জীবাণুমুক্তকরণ: তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করা হয়।
শিল্পক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তা
- বস্তুর পুরুত্ব নির্ণয়: তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে বিভিন্ন বস্তুর পুরুত্ব মাপা যায়।
- পাইপলাইনের ত্রুটি নির্ণয়: পাইপলাইনের ভেতরে কোনো ত্রুটি থাকলে তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে তা সনাক্ত করা যায়।
- খাদ্য সংরক্ষণ: তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্যকে জীবাণুমুক্ত করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
কৃষিক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তা
- উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদন: তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে উদ্ভিদের জিনে পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন ও উন্নত জাতের বীজ তৈরি করা যায়।
- পোকা নিয়ন্ত্রণ: তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করা যায়।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেজস্ক্রিয়তা
- পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র: তেজস্ক্রিয় পদার্থ যেমন ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব
তেজস্ক্রিয়তা আমাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এর কিছু ক্ষতিকর প্রভাব নিচে উল্লেখ করা হলো:
- শারীরিক ক্ষতি: তেজস্ক্রিয় রশ্মি মানবদেহের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব, এবং অন্যান্য মারাত্মক রোগ হতে পারে।
- জেনেটিক ক্ষতি: তেজস্ক্রিয়তা ডিএনএ-এর গঠন পরিবর্তন করে দিতে পারে, যা বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হতে পারে এবং জন্মগত ত্রুটি সৃষ্টি করতে পারে।
- পরিবেশ দূষণ: তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি মাটি, পানি ও বাতাসকে দূষিত করতে পারে।
উদাহরণ: চেরনোবিল ও ফুকুশিমা
চেরনোবিল এবং ফুকুশিমার পারমাণবিক বিপর্যয় তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের আরও সচেতন করেছে। এই দুর্ঘটনাগুলোতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ার কারণে বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
তেজস্ক্রিয়তা থেকে বাঁচার উপায়
তেজস্ক্রিয়তা থেকে পুরোপুরি বাঁচা হয়তো সম্ভব নয়, তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করে এর ক্ষতিকর প্রভাব কমানো যায়:
- তেজস্ক্রিয় এলাকায় কম থাকা: তেজস্ক্রিয় দূষণ আছে এমন এলাকা এড়িয়ে চলুন।
- সুরক্ষামূলক পোশাক: তেজস্ক্রিয় এলাকায় কাজ করার সময় সুরক্ষামূলক পোশাক পরিধান করুন।
- খাবার ও পানির সতর্কতা: তেজস্ক্রিয় দূষণমুক্ত খাবার ও পানি ব্যবহার করুন।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: তেজস্ক্রিয় এলাকায় বসবাস করলে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
অনেকের মনে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকে। এখানে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
তেজস্ক্রিয়তা কি ক্ষতিকর?
হ্যাঁ, তেজস্ক্রিয়তা মানবদেহ এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তবে, সঠিক মাত্রায় এবং নিরাপদে ব্যবহার করলে এর অনেক উপকারী দিকও রয়েছে।
তেজস্ক্রিয় পদার্থ কোথায় পাওয়া যায়?
তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রাকৃতিকভাবে মাটিতে, পানিতে এবং কিছু শিলাতে পাওয়া যায়। এছাড়াও, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কিছু শিল্প কারখানাতেও তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করা হয়।
তেজস্ক্রিয়তা মাপার একক কি?
তেজস্ক্রিয়তা মাপার একক হলো বেকেরেল (Becquerel – Bq) এবং কুরি (Curie – Ci)।
তেজস্ক্রিয়তা কতক্ষণ স্থায়ী হয়?
তেজস্ক্রিয় পদার্থের অর্ধায়ু (Half-life) বলে একটি বিষয় আছে। অর্ধায়ু হলো সেই সময়, যখন কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থের অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয় হয়ে যায়। বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থের অর্ধায়ু বিভিন্ন রকম হতে পারে; কারো কয়েক সেকেন্ড, আবার কারো কয়েক কোটি বছর পর্যন্ত হতে পারে।
তেজস্ক্রিয়তা কি শনাক্ত করা যায়?
হ্যাঁ, তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যেমন গাইগার-মুলার কাউন্টার (Geiger-Muller counter)।
তেজস্ক্রিয়তা: আমাদের জীবনে এর প্রভাব
তেজস্ক্রিয়তা আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একদিকে যেমন এটি আমাদের চিকিৎসায় সাহায্য করছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগছে, অন্যদিকে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কেও আমাদের সচেতন থাকতে হবে। তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার এবং ঝুঁকি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা আমাদের নিজেদের এবং পরিবেশের সুরক্ষার জন্য খুবই জরুরি।
আজ এ পর্যন্তই। আশা করি, তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দিতে পেরেছি। কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানাতে পারেন। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন!