একটা সময় ছিল, যখন উন্নয়নের মানে ছিল শুধু বড় বড় বিল্ডিং, রাস্তাঘাট আর শিল্প কারখানা। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। আমরা বুঝতে পারছি, শুধু এগুলোই যথেষ্ট নয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে হলে, উন্নয়নের ধারণাকে আরও একটু গভীর করে ভাবতে হবে। আর সেই গভীর চিন্তা থেকেই জন্ম নিয়েছে “টেকসই উন্নয়ন” (Tekসই Unnoyon) এর ধারণা।
আসুন, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা জানার চেষ্টা করি টেকসই উন্নয়ন আসলে কী, কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ, আর বাংলাদেশেই বা এর ভবিষ্যৎ কেমন।
টেকসই উন্নয়ন কী? (Tekসই Unnoyon Kake Bole?)
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, টেকসই উন্নয়ন হলো এমন একটি উন্নয়ন যা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। ধরুন, আপনার কাছে একটা সোনার ডিম দেওয়া হাঁস আছে। আপনি যদি প্রতিদিন একটা করে ডিম নেন, তাহলে হাঁসটা বেঁচে থাকবে এবং আপনাকে ডিম দিতে থাকবে। কিন্তু আপনি যদি একদিনেই সব ডিম পাওয়ার লোভে হাঁসটাকেই মেরে ফেলেন, তাহলে আর কোনো ডিম পাবেন না। টেকসই উন্নয়ন অনেকটা তেমনই।
জাতিসংঘের ব্রান্ডটল্যান্ড কমিশন ১৯৮৭ সালে টেকসই উন্নয়নের একটি সংজ্ঞা দেয়: “টেকসই উন্নয়ন হলো সেই উন্নয়ন যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতাকে ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে বর্তমানের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।”
টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত্তি (Mool Bhitti)
টেকসই উন্নয়নের তিনটি প্রধান স্তম্ভ রয়েছে:
- অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Arthonitik Unnoyon): অর্থনৈতিক উন্নয়ন দরকার, তবে সেটা যেন পরিবেশের ক্ষতি না করে। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে উৎপাদন বাড়াতে হবে।
- সামাজিক উন্নয়ন (Samajik Unnoyon): সমাজের সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান – এই মৌলিক চাহিদাগুলো যেন সবাই পূরণ করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। লিঙ্গ সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও জরুরি।
- পরিবেশগত উন্নয়ন (Poribeshgoto Unnoyon): পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। দূষণ কমাতে হবে, বনভূমি রক্ষা করতে হবে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এমন কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে।
এই তিনটি স্তম্ভকে একসঙ্গে মাথায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা করলে, সেটাই হবে টেকসই উন্নয়ন।
কেন টেকসই উন্নয়ন প্রয়োজন? (Keno Tekসই Unnoyon Proyojon?)
টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অনেক। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা (Prakritik Sampoder Surokkha): আমাদের পৃথিবী সীমিত সম্পদ নিয়ে গঠিত। কয়লা, তেল, গ্যাস – এগুলো একদিন শেষ হয়ে যাবে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে যেন আমরা এই সম্পদগুলো বুদ্ধিমানের মতো ব্যবহার করি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু বাঁচিয়ে রাখি।
- জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা (Jalobayu Poribortoner Mokabila): জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটা বড় হুমকি। কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। টেকসই উন্নয়ন এই ক্ষেত্রে আমাদের পথ দেখাতে পারে।
- দারিদ্র্য বিমোচন (Daridro Bimochan): টেকসই উন্নয়ন সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল মানুষদের উন্নয়নের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে সাহায্য করে। তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে।
- সুস্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন (Suswastho O Jibon Jatrar Man Unnoyon): টেকসই উন্নয়ন স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং উন্নত জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা দেয়। সকলের জন্য ভালো খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এর লক্ষ্য।
- ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী (Bovisshot Projonmer jonno Basjoggo Prithibi): আমরা যদি এখন নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে পরিবেশের ক্ষতি করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারব না। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে যেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটা সুন্দর ও সুস্থ পৃথিবীতে বাঁচতে পারে।
বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন (Bangladeshe Tekসই Unnoyon)
বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তবে, আমাদের মনে রাখতে হবে, এই উন্নয়ন যেন টেকসই হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টেকসই উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ (Challenges)
- জলবায়ু পরিবর্তন (Jalobayu Poriborton): বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি – এগুলো আমাদের উন্নয়নের পথে বড় বাধা।
- জনসংখ্যা বৃদ্ধি (Jonoshonkha Briddhi): আমাদের দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। সীমিত সম্পদের উপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন কঠিন হয়ে পড়বে।
- দারিদ্র্য (Daridro): এখনও অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
- অপরিকল্পিত নগরায়ণ (Oporikalpito Nogorayon): অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে, যা টেকসই উন্নয়নের পথে অন্তরায়।
টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশের সম্ভাবনা (Possibilities)
এত চ্যালেঞ্জের পরেও, বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।
- নবায়নযোগ্য জ্বালানি (Nabayan Joggo Jalaani): সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বায়োমাস – এই নবায়নযোগ্য জ্বালানিগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা পরিবেশ দূষণ কমাতে পারি। বাংলাদেশ সরকার এই খাতে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছে।
- কৃষি (Krishi): পরিবেশ-বান্ধব কৃষি পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারি। জৈব সার ব্যবহার, কম কীটনাশক ব্যবহার – এই পদ্ধতিগুলো টেকসই কৃষির অংশ।
- গার্মেন্টস শিল্প (Garments Shilpo): আমাদের গার্মেন্টস শিল্পকে আরও পরিবেশ-বান্ধব করতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
- শিক্ষা ও সচেতনতা (Shiksha O Sochetanota): টেকসই উন্নয়ন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ ও সমাজ সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে হবে।
টেকসই উন্নয়নে সরকার এবং সাধারণ মানুষের ভূমিকা (Sorkar ebong sadharon manusher bhumika)
টেকসই উন্নয়নে সরকার এবং সাধারণ মানুষ উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
-
সরকারের ভূমিকা:
- পরিবেশ সুরক্ষার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ করা।
- নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন এবং ব্যবহারে উৎসাহিত করা।
- টেকসই কৃষি এবং শিল্প বিকাশে সহায়তা করা।
- শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন করা।
- দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি জোরদার করা।
-
সাধারণ মানুষের ভূমিকা:
* বিদ্যুৎ এবং পানির অপচয় রোধ করা।
* প্লাস্টিক ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া এবং রিসাইকেল করা।
* গাছ লাগানো এবং পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা।
* টেকসই পণ্য এবং পরিষেবা ব্যবহার করা।
* টেকসই জীবনযাপন সম্পর্কে অন্যদের সচেতন করা। -
টেকসই উন্নয়নে কিছু বাস্তব উদাহরণ (Bastob Udahoron):
* ছাদ কৃষি: আপনার বাসার ছাদে বা বেলকনিতে সবজি এবং ফল গাছ লাগিয়ে আপনি নিজের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারেন এবং পরিবেশকে সবুজ রাখতে পারেন।
* সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার: আপনার বাড়িতে সোলার প্যানেল লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আপনি জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে পারেন।
* বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে আপনি তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে পারেন, যেমন বাগান পরিচর্যা এবং ঘর মোছা।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals – SDGs)
জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের উন্নয়নকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কতগুলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals) নামে পরিচিত। এগুলো হলো:
ক্রমিক | লক্ষ্য |
---|---|
১ | দারিদ্র্য বিমোচন |
২ | ক্ষুধা মুক্তি |
৩ | সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ |
৪ | গুণগত শিক্ষা |
৫ | লিঙ্গ সমতা |
৬ | নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন |
৭ | সাশ্রয়ী ও দূষণমুক্ত জ্বালানি |
৮ | শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি |
৯ | শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো |
১০ | বৈষম্য হ্রাস |
১১ | টেকসই শহর ও জনবসতি |
১২ | পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন |
১৩ | জলবায়ু কার্যক্রম |
১৪ | জলজ জীবন |
১৫ | স্থলজ জীবন |
১৬ | শান্তি, ন্যায়বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান |
১৭ | লক্ষ্য অর্জনে অংশীদারিত্ব |
এই লক্ষ্যগুলো অর্জনে বাংলাদেশ সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs):
এখানে টেকসই উন্নয়ন নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
-
টেকসই উন্নয়ন কি পরিবেশ সুরক্ষার সাথে সম্পর্কিত?
অবশ্যই। টেকসই উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো পরিবেশ সুরক্ষা। পরিবেশকে রক্ষা না করলে উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হবে না। -
টেকসই উন্নয়নে সাধারণ নাগরিকের ভূমিকা কী?
সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমরা অনেক কিছু করতে পারি। যেমন – বিদ্যুতের অপচয় কমানো, জল সাশ্রয় করা, বেশি করে গাছ লাগানো, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, ইত্যাদি। -
টেকসই উন্নয়নের জন্য কোন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত?
পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত। যেমন - সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ, জৈব সার, ইত্যাদি।
-
টেকসই উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
সরকারের উচিত পরিবেশ সুরক্ষার জন্য কঠোর আইন তৈরি করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো, এবং টেকসই কৃষি ও শিল্পের বিকাশে সহায়তা করা। -
টেকসই উন্নয়নের সুবিধাগুলো কী কী?
টেকসই উন্নয়নের সুবিধা অনেক। এর মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারি, প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে পারি, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে পারি, এবং দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারি।
উপসংহার (Conclusion)
টেকসই উন্নয়ন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সরকার, জনগণ, ব্যবসায়ী – সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
আমি বিশ্বাস করি, সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা অবশ্যই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব এবং বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে পারব। টেকসই উন্নয়নের পথে আপনার সামান্য অবদানও অনেক বড় পরিবর্তন আনতে পারে। তাই, আজ থেকেই শুরু করুন!