তড়িৎ আবেশ: বিদ্যুতের জাদু আপনার হাতের কাছে!
আচ্ছা, কখনো কি এমন হয়েছে যে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানোর পর সেই চিরুনি কাগজের টুকরোগুলোকে আকর্ষণ করছে? অথবা, বেলুন ঘষে দেওয়ালে লাগানোর চেষ্টা করেছেন? এগুলো সবই কিন্তু তড়িৎ আবেশের খেলা! তাহলে, আসুন আজকের ব্লগ থেকে আমরা জেনে নিই তড়িৎ আবেশ আসলে কী, কীভাবে কাজ করে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব কতটা।
তড়িৎ আবেশ (Electrostatic Induction) কী?
তড়িৎ আবেশ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে একটি চার্জিত বস্তুর কাছাকাছি অন্য একটি অনাহিত (uncharged) বস্তুকে আনলে দ্বিতীয় বস্তুটিতে ক্ষণিকের জন্য চার্জের সৃষ্টি হয়। মজার ব্যাপার হলো, এখানে কিন্তু কোনো তার সংযোগ লাগে না! অনেকটা যেন একজন বন্ধুর প্রভাবে অন্য বন্ধু প্রভাবিত হয়ে যায়, তেমনই ব্যাপার।
তড়িৎ আবেশের মূল ধারণা
ধরা যাক, আপনার কাছে একটা চার্জিত কাঁচদণ্ড (glass rod) আছে। এবার এই দণ্ডটিকে একটি ধাতব গোলকের (metal sphere) কাছাকাছি আনলেন। কী ঘটবে? কাঁচদণ্ডটি পজিটিভলি চার্জড হলে গোলকের মধ্যে থাকা নেগেটিভ চার্জগুলো কাঁচদণ্ডের দিকে আকৃষ্ট হবে, এবং পজিটিভ চার্জগুলো তার বিপরীত দিকে সরে যাবে। এর ফলে গোলকের এক প্রান্তে নেগেটিভ এবং অন্য প্রান্তে পজিটিভ চার্জের আধিক্য দেখা দেবে। এই ঘটনাটিই হলো তড়িৎ আবেশ।
আবেশ প্রক্রিয়া কিভাবে কাজ করে?
তড়িৎ আবেশের প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:
-
চার্জিত বস্তুর সান্নিধ্য: প্রথমে একটি চার্জিত বস্তুকে (যেমন কাঁচদণ্ড বা এবোনাইট দণ্ড) একটি অনাহিত পরিবাহীর (conductor) কাছাকাছি আনতে হবে।
-
চার্জের মেরুকরণ: চার্জিত বস্তুর প্রভাবে পরিবাহীর মধ্যে থাকা ইলেকট্রনগুলো স্থান পরিবর্তন করে। বিপরীতধর্মী চার্জগুলো কাছাকাছি চলে আসে এবং সমধর্মী চার্জগুলো দূরে সরে যায়।
-
আবিষ্ট চার্জ: এই স্থানান্তরের ফলে পরিবাহীর দুই প্রান্তে বিপরীতধর্মী চার্জের সৃষ্টি হয়। এই চার্জগুলোই হলো আবিষ্ট চার্জ (induced charge)।
-
সংযোগ বিচ্ছিন্ন: পরিবাহীটিকে যদি আর্থিং (earthing) করা হয়, তাহলে সমধর্মী চার্জগুলো পৃথিবীতে চলে যায় এবং বিপরীতধর্মী চার্জগুলো পরিবাহীতে আবদ্ধ থাকে।
-
চার্জের বিস্তার: আর্থিং সরিয়ে নিলে পরিবাহীতে শুধু বিপরীতধর্মী চার্জগুলো থাকে এবং তা পরিবাহীর পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে।
তড়িৎ আবেশের প্রকারভেদ
তড়িৎ আবেশ মূলত দুই প্রকার:
-
স্থির তড়িৎ আবেশ (Electrostatic Induction): যখন একটি চার্জিত বস্তু অন্য একটি পরিবাহীর কাছাকাছি আনা হয় এবং পরিবাহীতে চার্জের সৃষ্টি হয়, তখন তাকে স্থির তড়িৎ আবেশ বলে। এখানে চার্জগুলো স্থির থাকে।
-
চলমান তড়িৎ আবেশ (Electromagnetic Induction): যখন একটি পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র (magnetic field) কোনো পরিবাহীর সংস্পর্শে আসে, তখন ঐ পরিবাহীতে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এটা মূলত জেনারেটর এবং ট্রান্সফরমারে ব্যবহৃত হয়।
তড়িৎ আবেশ এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবন
আমরা হয়তো সবসময় বুঝতে পারি না, কিন্তু তড়িৎ আবেশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
-
বৈদ্যুতিক জেনারেটর: জেনারেটরের মূলনীতি হলো তড়িৎ আবেশ। এখানে চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে কয়েলের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়।
-
ট্রান্সফরমার: ট্রান্সফরমার ভোল্টেজ বাড়াতে বা কমাতে তড়িৎ আবেশ ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিরাপদে পাঠানো যায়।
-
টাচস্ক্রিন: আধুনিক স্মার্টফোনের টাচস্ক্রিনে তড়িৎ আবেশের নীতি ব্যবহার করা হয়। আপনার আঙুলের স্পর্শে স্ক্রিনে চার্জের পরিবর্তন ঘটে এবং সেই অনুযায়ী কাজ হয়।
- ফটোকপি মেশিন: ফটোকপি মেশিনে টোনার কার্টিজের মাধ্যমে কাগজে ছবি তৈরি করার প্রক্রিয়ায় তড়িৎ আবেশ ব্যবহৃত হয়।
তড়িৎ আবেশ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
তড়িৎ আবেশ বোঝার জন্য আরও কিছু বিষয় জানা দরকার। এগুলো হলো:
চার্জিং এবং গ্রাউন্ডিং (Earthing)
চার্জিং হলো কোনো বস্তুকে চার্জিত করার প্রক্রিয়া। এটা ঘর্ষণের মাধ্যমে, সংযোগের মাধ্যমে অথবা আবেশের মাধ্যমে করা যেতে পারে। অন্যদিকে, গ্রাউন্ডিং বা আর্থিং হলো কোনো বস্তুকে পৃথিবীর সাথে যুক্ত করা, যাতে অতিরিক্ত চার্জ পৃথিবীতে চলে যেতে পারে। এটা বৈদ্যুতিক সুরক্ষার জন্য খুবই জরুরি।
কুলম্বের সূত্র (Coulomb’s Law)
কুলম্বের সূত্র অনুযায়ী, দুটি চার্জের মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল তাদের চার্জের পরিমাণের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। এই সূত্র তড়িৎ আবেশের ঘটনা বুঝতে সাহায্য করে।
তড়িৎ ক্ষেত্র (Electric Field)
তড়িৎ ক্ষেত্র হলো কোনো চার্জের চারপাশে যে অঞ্চলে অন্য কোনো চার্জিত বস্তু আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল অনুভব করে। তড়িৎ আবেশের ক্ষেত্রে তড়িৎ ক্ষেত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তড়িৎ আবেশ: কিছু মজার পরীক্ষা
যদি আপনি হাতে-কলমে তড়িৎ আবেশের জাদু দেখতে চান, তাহলে কিছু সহজ পরীক্ষা করতে পারেন:
-
বেলুন এবং চুল: একটি বেলুনকে আপনার চুলে ঘষুন। দেখবেন, বেলুনটি চার্জিত হয়ে ছোট কাগজের টুকরোগুলোকে আকর্ষণ করছে। এমনকি, এটি দেওয়ালের সাথে আটকে থাকবে।
-
চিরুনি এবং কাগজ: একটি প্লাস্টিকের চিরুনিকে শুকনো চুলে ঘষে ছোট কাগজের টুকরোর কাছে ধরুন। দেখবেন, কাগজগুলো চিরুনির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে।
-
স্থির তড়িৎ বিক্ষণ যন্ত্র (Electroscope): এটি একটি যন্ত্র যা দিয়ে কোনো বস্তুতে চার্জের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়।
নিরাপত্তা টিপস
তড়িৎ নিয়ে কাজ করার সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত:
-
বৈদ্যুতিক তার বা সরঞ্জামের কাছাকাছি কাজ করার সময় রাবারের গ্লাভস এবং জুতা ব্যবহার করুন।
-
ভেজা হাতে কোনো বৈদ্যুতিক সুইচ স্পর্শ করবেন না। কারণ এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
-
উচ্চ ভোল্টেজের উৎস থেকে দূরে থাকুন।
আয়োজন এবং তড়িৎ আবেশের মধ্যে সম্পর্ক
আয়োজন (polarization) এবং তড়িৎ আবেশ একই মুদ্রার দুই পিঠ। তড়িৎ আবেশের সময়, একটি বস্তুর মধ্যে চার্জের যে পুনর্বিন্যাস ঘটে, সেটাই হলো আয়োজন। যখন একটি চার্জিত বস্তু অন্য একটি অনাহিত বস্তুর কাছাকাছি আসে, তখন অনাহিত বস্তুর অণুগুলোর মধ্যে পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জগুলো আলাদা হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকেই আয়োজন বলা হয়।
তড়িৎ আবেশের ব্যবহারিক প্রয়োগ
তড়িৎ আবেশের ব্যবহারিক প্রয়োগ অনেক। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ উল্লেখ করা হলো:
-
ক্যাপাসিটর: ক্যাপাসিটর হলো একটি বৈদ্যুতিক উপাদান যা চার্জ সঞ্চয় করতে ব্যবহৃত হয়। এর কার্যকারিতা তড়িৎ আবেশের নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি।
-
সেন্সর: বিভিন্ন ধরনের সেন্সর যেমন প্রক্সিমিটি সেন্সর (proximity sensor) এবং টাচ সেন্সর (touch sensor) তড়িৎ আবেশের মাধ্যমে কাজ করে।
-
ইলেকট্রোস্ট্যাটিক পেইন্টিং: এই পদ্ধতিতে তড়িৎ আবেশের মাধ্যমে পেইন্টকে চার্জিত করে কোনো বস্তুর উপর স্প্রে করা হয়। এর ফলে পেইন্ট সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং অপচয় কম হয়।
তড়িৎ আবেশ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
এখানে তড়িৎ আবেশ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
তড়িৎ আবেশ কি সর্বদা আকর্ষণ করে?
না, তড়িৎ আবেশ সবসময় আকর্ষণ করে না। যদি আপনি একটি পজিটিভলি চার্জড বস্তুকে একটি অনাহিত বস্তুর কাছে আনেন, তাহলে অনাহিত বস্তুর নেগেটিভ চার্জগুলো পজিটিভ চার্জের দিকে আকৃষ্ট হবে। কিন্তু যদি আপনি একটি নেগেটিভলি চার্জড বস্তুকে আনেন, তাহলে পজিটিভ চার্জগুলো আকৃষ্ট হবে। তাই, আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ উভয়ই হতে পারে, যা চার্জের ধরনের উপর নির্ভর করে।
তড়িৎ আবেশ এবং তড়িৎ সঞ্চালনের মধ্যে পার্থক্য কী?
তড়িৎ আবেশে দুটি বস্তুর মধ্যে কোনো সরাসরি সংযোগ থাকে না। একটি চার্জিত বস্তুর প্রভাবে অন্য বস্তুতে চার্জের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে, তড়িৎ সঞ্চালনে দুটি বস্তুর মধ্যে সরাসরি সংযোগের মাধ্যমে চার্জ স্থানান্তরিত হয়।
তড়িৎ আবেশ কি শুধু ধাতব বস্তুতে ঘটে?
তড়িৎ আবেশ যেকোনো পরিবাহী (conductor) বস্তুতে ঘটতে পারে, তবে ধাতব বস্তুতে এটি সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যায়। কারণ ধাতুতে প্রচুর সংখ্যক মুক্ত ইলেকট্রন থাকে, যা সহজেই স্থানান্তরিত হতে পারে।
তড়িৎ আবেশের সময় কি নতুন চার্জ তৈরি হয়?
না, তড়িৎ আবেশের সময় নতুন কোনো চার্জ তৈরি হয় না। বরং, বস্তুর মধ্যে থাকা চার্জগুলো পুনর্বিন্যাসিত হয়। অর্থাৎ, পজিটিভ এবং নেগেটিভ চার্জগুলো একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যায়।
তড়িৎ আবেশের উদাহরণ কী কী?
তড়িৎ আবেশের অনেক উদাহরণ আছে, যেমন:
- বেলুন দিয়ে চুল ঘষলে বেলুনের কাগজের টুকরোগুলোকে আকর্ষণ করা।
- জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন।
- টাচস্ক্রিন ডিভাইসের ব্যবহার।
তড়িৎ আবেশ: আরও কিছু বিষয়
তড়িৎ আবেশের ধারণা আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য কিছু অতিরিক্ত বিষয় আলোচনা করা হলো:
তড়িৎ বিভব (Electric Potential)
তড়িৎ বিভব হলো কোনো স্থানে একটি ইউনিট পজিটিভ চার্জ আনতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়। তড়িৎ আবেশের ক্ষেত্রে, চার্জগুলোর পুনর্বিন্যাসের কারণে বিভবের পরিবর্তন ঘটে।
ধারকত্ব (Capacitance)
ধারকত্ব হলো কোনো বস্তুর চার্জ ধারণ করার ক্ষমতা। ক্যাপাসিটর নামক যন্ত্রে এই ধারকত্ব ব্যবহার করা হয়, যা তড়িৎ আবেশের নীতিতে কাজ করে।
তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশ (Electromagnetic Induction)
তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশ হলো সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা পরিবাহীতে ভোল্টেজ বা বিদ্যুৎ তৈরির প্রক্রিয়া। এটি জেনারেটর, ট্রান্সফরমার ও ইন্ডাকশন মোটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রে ব্যবহৃত হয়। মাইকেল ফ্যারাডে এই আবেশ আবিষ্কার করেন।
শেষ কথা
তড়িৎ আবেশ হলো বিদ্যুতের একটি মজার খেলা। এটা শুধু একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এর অনেক ব্যবহার রয়েছে। আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি পড়ার পর আপনি তড়িৎ আবেশ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। যদি আপনার মনে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর হ্যাঁ, এই ব্লগটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না! কে জানে, হয়তো আপনার একটি শেয়ার অনেকের কাছে বিদ্যুতের এই জাদু পৌঁছে দেবে।