বিদ্যুৎ পরিবাহিতা: সহজ ভাষায় বুঝুন!
আচ্ছা, কখনো ভেবেছেন, বিদ্যুতের সুইচ টিপলেই ফ্যান ঘোরে কেন? বা মোবাইলের চার্জারটা প্লাগে লাগালেই ব্যাটারি ফুল হতে শুরু করে কীভাবে? এর পেছনে কাজ করে একটা দারুণ জিনিস – তড়িৎ পরিবাহিতা (Electrical Conductivity)! জিনিসটা কঠিন শোনালেও, আসলে খুবই সহজ। আসুন, আজ আমরা এই তড়িৎ পরিবাহিতা কী, কীভাবে কাজ করে, আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর কী প্রভাব, তা নিয়ে সহজ ভাষায় আলোচনা করি।
তড়িৎ পরিবাহিতা কী?
তড়িৎ পরিবাহিতা হলো কোনো পদার্থের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার ক্ষমতা। সহজ ভাষায়, কোনো জিনিস কতটা সহজে বিদ্যুৎকে তার ভেতর দিয়ে যেতে দিতে পারে, সেটাই হলো তার তড়িৎ পরিবাহিতা। যে পদার্থের পরিবাহিতা যত বেশি, সেটি তত ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী।
রোধ এবং পরিবাহিতা: উল্টো পথে যাত্রা
রোধ (Resistance) হলো পরিবাহিতার ঠিক উল্টো। রোধ মানে হলো বিদ্যুৎ চলাচলে বাধা দেওয়া। যে পদার্থের রোধ যত বেশি, তার পরিবাহিতা তত কম। যেমন, তামা (Copper) খুব ভালো পরিবাহী, তাই এর রোধ কম। অন্যদিকে, কাঠ বা প্লাস্টিক বিদ্যুৎ পরিবহন করে না বললেই চলে, তাই এদের রোধ অনেক বেশি।
কীভাবে কাজ করে তড়িৎ পরিবাহিতা?
তড়িৎ পরিবাহিতার মূল রহস্য লুকিয়ে আছে পদার্থের পরমাণুগুলোর মধ্যে থাকা ইলেকট্রনগুলোর (Electrons) মধ্যে।
মুক্ত ইলেকট্রনের ভূমিকা
ধাতুর পরমাণুগুলোর বাইরের কক্ষে কিছু “মুক্ত ইলেকট্রন” থাকে। এই ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর সঙ্গে খুব হালকাভাবে আবদ্ধ থাকে এবং সহজেই এক পরমাণু থেকে অন্য পরমাণুতে চলাচল করতে পারে। যখন কোনো পরিবাহীর দুই প্রান্তে ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয় (যেমন ব্যাটারি সংযোগ করলে), তখন এই মুক্ত ইলেকট্রনগুলো একটি নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এই ইলেকট্রনের প্রবাহই হলো বিদ্যুৎ।
পরিবাহিতা এবং পদার্থের গঠন
বিভিন্ন পদার্থের পরিবাহিতা বিভিন্ন হওয়ার কারণ হলো তাদের পরমাণু গঠন এবং মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা।
- ধাতু (Metals): ধাতুগুলোতে প্রচুর সংখ্যক মুক্ত ইলেকট্রন থাকে। তাই এরা খুব সহজেই বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে। সোনা (Gold), রূপা (Silver), তামা (Copper), অ্যালুমিনিয়াম (Aluminium) ইত্যাদি ভালো পরিবাহী।
- অন্তরক (Insulators): অন্তরক পদার্থগুলোতে খুব কম সংখ্যক মুক্ত ইলেকট্রন থাকে অথবা একেবারেই থাকে না। তাই এরা বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে না। কাঠ, প্লাস্টিক, রাবার ইত্যাদি হলো অন্তরকের উদাহরণ।
- অর্ধপরিবাহী (Semiconductors): অর্ধপরিবাহী পদার্থগুলো সাধারণ অবস্থায় অন্তরকের মতো আচরণ করে, কিন্তু কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে (যেমন তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা ভেজাল মেশানো হলে) এরা বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে। সিলিকন (Silicon) এবং জার্মেনিয়াম (Germanium) হলো বহুল ব্যবহৃত অর্ধপরিবাহী।
দৈনন্দিন জীবনে তড়িৎ পরিবাহিতার ব্যবহার
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তড়িৎ পরিবাহিতার অসংখ্য ব্যবহার রয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
-
বৈদ্যুতিক তার (Electrical Wires): বাসা-বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য যে তার ব্যবহার করা হয়, তা তামা বা অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি। কারণ এই ধাতুগুলো খুব ভালো পরিবাহী।
-
বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম (Electrical Appliances): আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্রায় সকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, যেমন – ফ্যান, লাইট, টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার ইত্যাদি তৈরিতে পরিবাহী তার ব্যবহার করা হয়।
-
ইলেকট্রনিক্স (Electronics): মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ আধুনিক সকল ইলেকট্রনিক ডিভাইসে অর্ধপরিবাহী (Semiconductor) ব্যবহার করা হয়।
তড়িৎ পরিবাহিতা: কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
তড়িৎ পরিবাহিতা সম্পর্কে আরও কিছু বিষয় জেনে রাখা ভালো:
তাপমাত্রা এবং পরিবাহিতা
সাধারণত, তাপমাত্রা বাড়লে ধাতুর পরিবাহিতা কমে যায়। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পরমাণুগুলোর কম্পন বাড়ে, যা ইলেকট্রনের প্রবাহে বাধা দেয়। অন্যদিকে, অর্ধপরিবাহীর ক্ষেত্রে তাপমাত্রা বাড়লে পরিবাহিতা বাড়ে।
পরিবাহিতা পরিমাপের একক
পরিবাহিতা পরিমাপের একক হলো সিমেন্স (Siemens), সংক্ষেপে S। কোনো পদার্থের পরিবাহিতা যত বেশি সিমেন্স, সেটি তত ভালো পরিবাহী।
বিভিন্ন পদার্থের পরিবাহিতা
নিচে কয়েকটি সাধারণ পদার্থের পরিবাহিতা দেওয়া হলো (২৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায়):
| পদার্থ | পরিবাহিতা (S/m) |
|---|---|
| রূপা (Silver) | ৬.৩ x ১০৭ |
| তামা (Copper) | ৫.৯৬ x ১০৭ |
| সোনা (Gold) | ৪.৫ x ১০৭ |
| অ্যালুমিনিয়াম (Aluminium) | ৩.৭৭ x ১০৭ |
| লোহা (Iron) | ১.০ x ১০৭ |
| কার্বন (Carbon) | ১.০ x ১০৫ |
| সিলিকন (Silicon) | ১.৫৬ x ১০-৩ |
| কাঁচ (Glass) | ১০-১০ – ১০-১৪ |
| রাবার (Rubber) | ১০-১৫ |
FAQ: তড়িৎ পরিবাহিতা নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন
এখানে তড়িৎ পরিবাহিতা নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
তড়িৎ পরিবাহিতা এবং আপেক্ষিক পরিবাহিতা (Conductivity vs. Resistivity) এর মধ্যে পার্থক্য কি?
আপেক্ষিক পরিবাহিতা (Resistivity) হলো কোনো পদার্থের বিদ্যুৎ পরিবহনে বাধার পরিমাণ। এটি পরিবাহিতার বিপরীত। পরিবাহিতা হলো বিদ্যুৎ পরিবহনের ক্ষমতা, আর আপেক্ষিক পরিবাহিতা হলো সেই পরিবহনে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা। পরিবাহিতা মাপা হয় সিমেন্স (Siemens) এককে, যেখানে আপেক্ষিক পরিবাহিতা মাপা হয় ওহম-মিটার (Ohm-meter) এককে।
কোন কোন বিষয়গুলো তড়িৎ পরিবাহিতা প্রভাবিত করে?
বেশ কয়েকটি বিষয় তড়িৎ পরিবাহিতা প্রভাবিত করতে পারে:
- তাপমাত্রা: তাপমাত্রা বাড়লে ধাতুর পরিবাহিতা সাধারণত কমে যায়, কিন্তু অর্ধপরিবাহীর পরিবাহিতা বাড়ে।
- ভেজাল (Impurities): পরিবাহী পদার্থে ভেজাল মেশালে এর পরিবাহিতা কমে যেতে পারে।
- চাপ (Pressure): কিছু পদার্থের ক্ষেত্রে চাপের পরিবর্তন পরিবাহিতার উপর প্রভাব ফেলে।
- চুম্বক ক্ষেত্র (Magnetic Field): চুম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করলে কিছু পদার্থের পরিবাহিতা পরিবর্তিত হতে পারে (যেমন হল প্রভাব)।
সুপার কন্ডাক্টর (Superconductor) কি?
সুপার কন্ডাক্টর হলো এমন কিছু পদার্থ, যা একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নিচে (ক্রান্তি তাপমাত্রা বা Critical Temperature) কোনো রকম রোধ ছাড়াই বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে। এদের পরিবাহিতা সাধারণ পরিবাহীর তুলনায় অনেক বেশি। সুপার কন্ডাক্টর ব্যবহার করে শক্তিশালী চুম্বক, দ্রুতগতির ইলেকট্রনিক্স এবং শক্তি সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব।
তড়িৎ পরিবাহিতা মাপার পদ্ধতি কী?
তড়িৎ পরিবাহিতা মাপার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো ভোল্টেজ এবং কারেন্ট মেপে ওহমের সূত্র (Ohm’s Law) ব্যবহার করা। এছাড়াও, পরিবাহিতা মিটার (Conductivity Meter) ব্যবহার করে সরাসরি পরিবাহিতা পরিমাপ করা যায়।
মানবদেহে তড়িৎ পরিবাহিতার ভূমিকা কী?
মানবদেহেও তড়িৎ পরিবাহিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমাদের স্নায়ুগুলো (Nerves) হলো জৈব পরিবাহী, যা মস্তিষ্কের নির্দেশ শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে দেয়। হৃদস্পন্দন এবং পেশী সঞ্চালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোও তড়িৎ সংকেতের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে, মানুষের শরীরের রোধ অনেক বেশি হওয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
অর্ধপরিবাহী এবং এর ব্যবহার
অর্ধপরিবাহী (Semiconductors) হলো এমন পদার্থ, যাদের পরিবাহিতা ধাতু এবং অন্তরকের মাঝামাঝি। এদের ব্যবহার আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
ডোপিং (Doping)
ডোপিং হলো অর্ধপরিবাহীর পরিবাহিতা পরিবর্তন করার একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় অর্ধপরিবাহীর মধ্যে কিছু ভেজাল (Impurities) মেশানো হয়, যা এর ইলেকট্রনিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে। ডোপিং দুই ধরনের হতে পারে:
- N-টাইপ ডোপিং (N-type Doping): এই প্রক্রিয়ায় এমন ভেজাল মেশানো হয়, যা অতিরিক্ত ইলেকট্রন সরবরাহ করে (যেমন ফসফরাস)। এর ফলে অর্ধপরিবাহীর পরিবাহিতা বাড়ে।
- P-টাইপ ডোপিং (P-type Doping): এই প্রক্রিয়ায় এমন ভেজাল মেশানো হয়, যা ইলেকট্রনের অভাব তৈরি করে (যা হোল নামে পরিচিত) (যেমন বোরন)। এর ফলেও অর্ধপরিবাহীর পরিবাহিতা বৃদ্ধি পায়।
ট্রানজিস্টর (Transistor)
ট্রানজিস্টর হলো অর্ধপরিবাহী দিয়ে তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ ডিভাইস, যা ইলেকট্রনিক সংকেতকে বিবর্ধিত (Amplify) করতে বা সুইচ হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের একটি অপরিহার্য উপাদান।
ডায়োড (Diode)
ডায়োড হলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্ধপরিবাহী ডিভাইস, যা একদিকে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করতে দেয়, কিন্তু বিপরীত দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহে বাধা দেয়। এটি পাওয়ার সাপ্লাই, সিগন্যাল ডিটেকশন এবং অন্যান্য অনেক ইলেকট্রনিক সার্কিটে ব্যবহৃত হয়।
তড়িৎ পরিবাহিতা: ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
তড়িৎ পরিবাহিতা নিয়ে গবেষণা ভবিষ্যতের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
নতুন পরিবাহী পদার্থের সন্ধান
বিজ্ঞানীরা এমন নতুন পরিবাহী পদার্থের সন্ধানে কাজ করছেন, যা আরও বেশি কার্যকর এবং পরিবেশবান্ধব হবে। গ্রাফিন (Graphene) এবং অন্যান্য ন্যানোমেটেরিয়াল (Nanomaterials) এক্ষেত্রে বিশেষ সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
শক্তি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি
উন্নত পরিবাহী পদার্থ ব্যবহার করে শক্তি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি তৈরি করা সম্ভব। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ অপচয় কমানো এবং পরিবেশের উপর চাপ কমানো যায়।
উন্নত ইলেকট্রনিক্স
অর্ধপরিবাহী প্রযুক্তির আরও উন্নয়নের মাধ্যমে ছোট, দ্রুতগতির এবং আরও শক্তিশালী ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরি করা সম্ভব।
উপসংহার
তড়িৎ পরিবাহিতা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জড়িয়ে আছে। এই বিষয়টি ভালোভাবে বুঝলে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারব এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার আরও ভালোভাবে শিখতে পারব।
আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি পড়ার পর তড়িৎ পরিবাহিতা সম্পর্কে আপনার ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। যদি আপনার আরও কিছু জানার থাকে, তবে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আর এই লেখাটি ভালো লাগলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!






