আচ্ছা, ভাবুন তো, আপনি একটি বিশাল খেলার মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন। চারপাশে শুধু মানুষ আর মানুষ! কারো ধাক্কাধাক্কিতে আপনি অস্থির, আবার কেউ হয়তো আপনাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। অনেকটা এরকমই হয় যখন আমরা “তড়িৎ তীব্রতা” নিয়ে কথা বলি। কিন্তু ভয় নেই, এই জটিল বিষয়টিকে আমরা সহজ করে বুঝবো!
তড়িৎ তীব্রতা: বিদ্যুতের ঝাঁজটা আসলে কী?
তড়িৎ তীব্রতা (Electric Field Intensity) হলো কোনো তড়িৎ ক্ষেত্রে (Electric Field) একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে একটি একক ধনাত্মক আধান (Unit Positive Charge) রাখলে সেটি যে বল অনুভব করে, সেই বলের মান। সহজ ভাষায়, এটা হলো কোনো এলাকায় বিদ্যুতের “জোর” বা “ক্ষমতা” কতটা, তার একটি পরিমাপ।
তাহলে দাঁড়ালো, তড়িৎ তীব্রতা একটি ভেক্টর রাশি (Vector Quantity), কারণ এর মান এবং দিক দুটোই আছে। এর দিক হলো সেই দিকে, যে দিকে একটি ধনাত্মক আধান বল অনুভব করবে।
একটু গভীর ভাবে দেখা যাক:
মনে করুন, একটি চার্জিত বস্তু (Charged Object) একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থির আছে। এই বস্তুটি তার চারপাশে একটি তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি করবে। এখন, যদি আপনি অন্য একটি ছোট ধনাত্মক চার্জ ঐ ক্ষেত্রের মধ্যে রাখেন, তাহলে প্রথম চার্জটি দ্বিতীয়টির উপর একটি বল প্রয়োগ করবে। এই বলের মান এবং দিকই হলো ঐ স্থানের তড়িৎ তীব্রতা।
যদি E
তড়িৎ তীব্রতা হয় এবং q
আধানের উপর F
বল প্রয়োগ করা হয়, তাহলে আমরা লিখতে পারি:
E = F/q
এর মানে হলো, তড়িৎ তীব্রতা হলো প্রতি একক আধানে প্রযুক্ত বল।
তড়িৎ তীব্রতা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
জানেন তো, তড়িৎ তীব্রতা শুধু একটা সংজ্ঞা নয়, এর অনেক ব্যবহারিক গুরুত্বও রয়েছে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
- তড়িৎ ক্ষেত্র বোঝা: কোনো স্থানে তড়িৎ ক্ষেত্র কেমন, তা জানতে তড়িৎ তীব্রতা ব্যবহার করা হয়।
- বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ডিজাইন: টিভি, মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে পাওয়ার প্ল্যান্ট পর্যন্ত, সব বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ডিজাইন করার সময় তড়িৎ তীব্রতা হিসাব করা হয়।
- আধানের গতিপথ: একটি তড়িৎ ক্ষেত্রে কোনো আধান কীভাবে চলবে, তা জানতেও তড়িৎ তীব্রতা কাজে লাগে।
দৈনন্দিন জীবনে তড়িৎ তীব্রতা
আমরা হয়তো সরাসরি তড়িৎ তীব্রতা মাপি না, কিন্তু এর প্রভাব আমাদের চারপাশে সবসময় বিদ্যমান। যেমন:
- বিদ্যুৎ চমকানোর সময় আমরা যে আলো দেখি, তা আসলে বাতাসের মধ্যে তড়িৎ তীব্রতার কারণে হয়।
- আমাদের বাসার বৈদ্যুতিক তারগুলোতে তড়িৎ প্রবাহের কারণে চারপাশে একটি তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি হয়।
তড়িৎ বিভব (Electric Potential) বনাম তড়িৎ তীব্রতা – পার্থক্যটা কোথায়?
অনেকেই তড়িৎ বিভব (Electric Potential) এবং তড়িৎ তীব্রতাকে গুলিয়ে ফেলেন। এদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আসুন, সেগুলো দেখে নেওয়া যাক:
বৈশিষ্ট্য | তড়িৎ বিভব (Electric Potential) | তড়িৎ তীব্রতা (Electric Field Intensity) |
---|---|---|
সংজ্ঞা | অসীম দূরত্ব থেকে একটি একক ধনাত্মক আধানকে তড়িৎ ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে আনতে যে কাজ করতে হয়। | কোনো তড়িৎ ক্ষেত্রে একটি একক ধনাত্মক আধান যে বল অনুভব করে। |
রাশি | স্কেলার রাশি (Scalar Quantity) – শুধু মান আছে | ভেক্টর রাশি (Vector Quantity) – মান ও দিক উভয়ই আছে |
একক | ভোল্ট (Volt – V) | নিউটন ক প্রতি কুলম্ব (Newton per Coulomb – N/C) অথবা ভোল্ট ক প্রতি মিটার (Volt per meter – V/m) |
সম্পর্ক | V = -∫E.dl |
E = -∇V (তড়িৎ বিভবের নতি) |
সহজ ভাষায়, তড়িৎ বিভব হলো কোনো স্থানের “বৈদ্যুতিক উচ্চতা”, আর তড়িৎ তীব্রতা হলো সেই উচ্চতার “ঢাল”।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে তড়িৎ তীব্রতার উদাহরণ
তড়িৎ তীব্রতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হতে পারে। কিছু সাধারণ উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
একটি বিন্দু চার্জের (Point Charge) জন্য তড়িৎ তীব্রতা:
যদি একটি বিন্দু চার্জ q
থেকে r
দূরত্বে তড়িৎ তীব্রতা E
হয়, তাহলে:
E = k * |q| / r²
এখানে k
হলো কুলম্বের ধ্রুবক (Coulomb’s constant), যার মান প্রায় 8.99 x 10^9 N m²/C²
.
একটি সুষমভাবে চার্জিত পাতের (Uniformly Charged Sheet) জন্য তড়িৎ তীব্রতা:
একটি অসীম আকারের চার্জিত পাতের নিকটে তড়িৎ তীব্রতা E
হলো:
E = σ / (2 * ε₀)
এখানে σ
হলো আধানের তল ঘনত্ব (Surface Charge Density) এবং ε₀
হলো শূন্য স্থানে ভেদনযোগ্যতা (Permittivity of free space), যার মান প্রায় 8.854 x 10^-12 C²/N m²
.
একটি ধারকের (Capacitor) মধ্যে তড়িৎ তীব্রতা:
একটি সমান্তরাল পাতের ধারকের মধ্যে তড়িৎ তীব্রতা E
হলো:
E = V / d
এখানে V
হলো পাতের মধ্যে বিভব পার্থক্য (Potential Difference) এবং d
হলো তাদের মধ্যে দূরত্ব।
তড়িৎ তীব্রতা নির্ণয় করার পদ্ধতি
তড়িৎ তীব্রতা নির্ণয় করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, যেমন:
- সরাসরি পরিমাপ: বিশেষ কিছু যন্ত্র ব্যবহার করে সরাসরি তড়িৎ তীব্রতা মাপা যায়।
- কুলম্বের সূত্র (Coulomb’s Law): কোনো আধানের উপর প্রযুক্ত বল থেকে তড়িৎ তীব্রতা নির্ণয় করা যায়।
- গাউসের সূত্র (Gauss’s Law): এটি তড়িৎ ক্ষেত্র বের করার একটি শক্তিশালী উপায়, বিশেষ করে যখন সিমেট্রি থাকে।
ગાઉસের সূত্র ব্যবহার করে তড়িৎ তীব্রতা নির্ণয়
গাউসের সূত্র অনুসারে, কোনো আবদ্ধ পৃষ্ঠের (Closed Surface) মধ্যে দিয়ে অতিক্রান্ত মোট তড়িৎ ফ্লাক্স (Electric Flux) হলো ঐ পৃষ্ঠের মধ্যে আবদ্ধ মোট চার্জের সমান।
∮ E . dA = Q / ε₀
এখানে, E
হলো তড়িৎ তীব্রতা, dA
হলো ক্ষেত্রফলের ক্ষুদ্র অংশ, Q
হলো আবদ্ধ চার্জ এবং ε₀
হলো শূন্য স্থানের ভেদনযোগ্যতা। এই সূত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের বস্তুর জন্য তড়িৎ তীব্রতা বের করা যায়।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা তড়িৎ তীব্রতা সম্পর্কে আপনার ধারণা আরও স্পষ্ট করবে:
প্রশ্ন: তড়িৎ তীব্রতার একক কী?
উত্তর: তড়িৎ তীব্রতার একক হলো নিউটন ক প্রতি কুলম্ব (N/C) অথবা ভোল্ট ক প্রতি মিটার (V/m).
প্রশ্ন: তড়িৎ তীব্রতা কি একটি স্কেলার রাশি নাকি ভেক্টর রাশি?
উত্তর: তড়িৎ তীব্রতা একটি ভেক্টর রাশি, কারণ এর মান এবং দিক উভয়ই আছে।
প্রশ্ন: দুটি চার্জের মধ্যে তড়িৎ তীব্রতা কীভাবে কাজ করে?
উত্তর: দুটি চার্জের মধ্যে তড়িৎ তীব্রতা কুলম্বের সূত্র অনুযায়ী কাজ করে। সমধর্মী চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করে এবং বিপরীত ধর্মী চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে।
প্রশ্ন: তড়িৎ তীব্রতা এবং ভেদনযোগ্যতার (Permittivity) মধ্যে সম্পর্ক কী?
উত্তর: তড়িৎ তীব্রতা এবং ভেদনযোগ্যতার মধ্যে একটি বিপরীত সম্পর্ক রয়েছে। ভেদনযোগ্যতা যত বেশি, তড়িৎ তীব্রতা তত কম।
প্রশ্ন: তড়িৎ তীব্রতা পরিমাপ করার জন্য কোন যন্ত্র ব্যবহার করা হয়?
উত্তর: তড়িৎ তীব্রতা পরিমাপ করার জন্য ইলেকট্রোমিটার (Electrometer) অথবা ভোল্টমিটারের সাথে ক্যাপাসিটর ব্যবহার করা হয়।
তড়িৎ তীব্রতা নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- পৃথিবীর চারপাশে একটি প্রাকৃতিক তড়িৎ ক্ষেত্র রয়েছে, যার গড় তীব্রতা প্রায় 100 V/m।
- বিদ্যুৎ চমকানোর সময় তড়িৎ তীব্রতা কয়েক মিলিয়ন ভোল্ট প্রতি মিটারে পৌঁছাতে পারে!
- তড়িৎ তীব্রতা ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা কণাaccelerator (Particle Accelerator) তৈরি করেছেন, যা দিয়ে পরমাণুর গঠন এবং মৌলিক কণা নিয়ে গবেষণা করা হয়।
আশা করি, “তড়িৎ তীব্রতা কাকে বলে” এই প্রশ্নের উত্তর আপনি সহজভাবে বুঝতে পেরেছেন। যদি এখনও কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাসা করুন! পদার্থবিজ্ঞান এমনই, একটু গভীরে ডুব দিলে অনেক মজার জিনিস খুঁজে পাওয়া যায়।