বিদ্যুৎ চমকালে যেমন গা ছমছম করে, তেমনি “তড়িৎচালক বল” নামটা শুনলেই কেমন একটা ভারী ভারী অনুভূতি হয়, তাই না? কিন্তু ব্যাপারটা আসলে অত কঠিন নয়। আসুন, আজকে আমরা সহজ ভাষায়, একটু গল্প করে, “তড়িৎচালক বল” (Electro-Motive Force বা EMF) জিনিসটা কী, সেটা জেনে নিই।
বিদ্যুৎ মানে কী?
আলো, পাখা, মোবাইল চার্জার – সবকিছুই তো চলে বিদ্যুতে। কিন্তু এই বিদ্যুতের আসল রূপটা কী? ছোটবেলায় পড়েছিলাম, বিদ্যুৎ হলো ইলেকট্রনের স্রোত। অনেকটা নদীর জলের মতো। জলের স্রোত যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়, তেমনি ইলেকট্রনগুলোও তার দিয়ে তৈরি পথ ধরে ছুটে চলে।
তড়িৎচালক বল (Electro-Motive Force – EMF) কী?
এখন প্রশ্ন হলো, ইলেকট্রনগুলো এমনি এমনি দৌড়াবে কেন? নিশ্চয়ই কেউ তাদের ধাক্কা দিচ্ছে, তাই না? এই ধাক্কা দেওয়ার কাজটা করে তড়িৎচালক বল। একে সংক্ষেপে EMF বলা হয়।
তাহলে সোজা কথায়, তড়িৎচালক বল হলো সেই শক্তি যা কোনো পরিবাহীর (যেমন তার) মধ্যে ইলেকট্রনগুলোকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে বাধ্য করে। এটা অনেকটা পাম্পের মতো, যা জলকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঠেলে পাঠায়।
তড়িৎচালক বলকে আমরা ভোল্ট (Volt) এককে মাপি।
EMF-এর উৎস:
EMF তৈরি হতে পারে বিভিন্ন উৎস থেকে। কয়েকটা প্রধান উৎস নিচে উল্লেখ করা হলো:
- ব্যাটারি (Battery): ব্যাটারি হলো EMF-এর সবচেয়ে পরিচিত উৎস। এর ভেতরে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, যা ইলেকট্রনগুলোকে ধাক্কা দেয়।
- জেনারেটর (Generator): জেনারেটর যান্ত্রিক শক্তিকে (Mechanical energy) কাজে লাগিয়ে EMF তৈরি করে। বড় জেনারেটরগুলোতে তার এবং চুম্বক ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়।
- **সৌরকোষ (Solar cell):**সৌরকোষ বা সোলার প্যানেল সূর্যের আলো থেকে সরাসরি EMF তৈরি করতে পারে।
- **থার্মোকাপল (Thermocouple):**দুটি ভিন্ন ধাতু ব্যবহার করে তাপমাত্রার পার্থক্য থেকে EMF তৈরি করা যায়।
তড়িৎচালক বল কিভাবে কাজ করে?
ধরা যাক, আপনার কাছে একটা ব্যাটারি আছে। ব্যাটারির দুটো মাথা থাকে – একটা পজিটিভ (+) আর একটা নেগেটিভ (-)। ব্যাটারির ভেতরে রাসায়নিক বিক্রিয়া হওয়ার ফলে নেগেটিভ প্রান্তে ইলেকট্রন জমা হতে থাকে। এই ইলেকট্রনগুলো পজিটিভ প্রান্তের দিকে যেতে চায়, কিন্তু যেতে পারার কোনো রাস্তা পায় না।
যখন আপনি ব্যাটারির সাথে একটা তার (wire) যোগ করেন, তখন একটা পথ তৈরি হয়। নেগেটিভ প্রান্তের ইলেকট্রনগুলো তারের মধ্যে দিয়ে পজিটিভ প্রান্তের দিকে ছুটতে শুরু করে। এই যে ইলেকট্রনের স্রোত, এটাই হলো বিদ্যুৎ। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটা চালানোর জন্য যে শক্তি দরকার, সেটাই হলো তড়িৎচালক বল বা EMF।
তড়িৎচালক বল (EMF) এবং বিভব পার্থক্য (Potential Difference)
অনেকেই তড়িৎচালক বল (EMF) এবং বিভব পার্থক্যকে একই জিনিস মনে করেন। তবে এদের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। আসুন, সেগুলো জেনে নিই:
EMF (তড়িৎচালক বল):
- EMF হলো কোনো উৎসের (source) তৈরি করা সেই সর্বোচ্চ বিভব, যা বর্তনীতে (circuit) বিদ্যুৎ প্রবাহ শুরু করতে পারে।
- এটা মূলত শক্তি সরবরাহকারী উৎসের বৈশিষ্ট্য।
- যখন বর্তনীতে কোনো বিদ্যুৎ প্রবাহ থাকে না, তখনও EMF বিদ্যমান থাকতে পারে।
বিভব পার্থক্য (Potential Difference):
- বিভব পার্থক্য হলো বর্তনীর দুই বিন্দুর মধ্যে বিভবের পার্থক্য, যা বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে তৈরি হয়।
- এটা বর্তনীর কোনো উপাদানের (যেমন রোধ) মধ্যে বিদ্যুতের চাপের পার্থক্য নির্দেশ করে।
- বিভব পার্থক্য তখনই তৈরি হয়, যখন বর্তনীতে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়।
নিচের ছকটি দেখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে:
বৈশিষ্ট্য | তড়িৎচালক বল (EMF) | বিভব পার্থক্য |
---|---|---|
সংজ্ঞা | উৎস দ্বারা সৃষ্ট সর্বোচ্চ বিভব | বর্তনীর দুই বিন্দুর মধ্যে বিভবের পার্থক্য |
উৎস | বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী উৎস (ব্যাটারি, জেনারেটর) | বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে বর্তনীর উপাদানসমূহে তৈরি হয় |
পরিমাপ | যখন বর্তনী খোলা থাকে (open circuit) | যখন বর্তনীতে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় |
সম্পর্ক | EMF হলো বিভব পার্থক্যের কারণ | বিভব পার্থক্য হলো EMF-এর ফল |
দৈনন্দিন জীবনে তড়িৎচালক বল (EMF)
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে EMF-এর ব্যবহার অসংখ্য। কয়েকটা উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
- মোবাইল ফোন: মোবাইলের ব্যাটারি EMF-এর মাধ্যমে ফোনটিকে সচল রাখে।
- গাড়ি: গাড়ির ব্যাটারি стартер মোটরকে চালু করে এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম যেমন লাইট, হর্ন ইত্যাদি চালাতে সাহায্য করে।
- বিদ্যুৎ সরবরাহ: পাওয়ার প্ল্যান্টে জেনারেটরের মাধ্যমে EMF তৈরি করে আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
- রিমোট কন্ট্রোল: রিমোটের ব্যাটারি EMF তৈরি করে, যা ইনফ্রারেড সিগন্যাল পাঠাতে কাজে লাগে।
তড়িৎচালক বল (EMF) বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs):
তড়িৎচালক বল নিয়ে আপনাদের মনে নানা প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
তড়িৎচালক বলের একক কী?
তড়িৎচালক বলের একক হলো ভোল্ট (Volt)। বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টার নামানুসারে এই এককের নামকরণ করা হয়েছে।
কীভাবে তড়িৎচালক বল মাপা হয়?
তড়িৎচালক বল মাপার জন্য ভোল্টমিটার (Voltmeter) ব্যবহার করা হয়। ভোল্টমিটারকে বর্তনীর (circuit) সঙ্গে সমান্তরালভাবে (parallel) যুক্ত করতে হয়।
তড়িৎচালক বল কি একটি ভেক্টর রাশি?
না, তড়িৎচালক বল কোনো ভেক্টর রাশি নয়। এটি একটি স্কেলার রাশি (scalar quantity)। এর শুধু মান আছে, কোনো দিক নেই।
তড়িৎচালক বল কিভাবে বৃদ্ধি করা যায়?
তড়িৎচালক বল বৃদ্ধি করার উপায় নির্ভর করে উৎসের ওপর। যেমন, ব্যাটারির ক্ষেত্রে বেশি ভোল্টেজের ব্যাটারি ব্যবহার করতে হবে। জেনারেটরের ক্ষেত্রে ঘূর্ণন গতি (rotational speed) বাড়িয়ে বা শক্তিশালী চুম্বক ব্যবহার করে EMF বাড়ানো যায়।
EMF এবং কারেন্ট এর মধ্যে সম্পর্ক কি?
EMF হলো কারেন্টের উৎস। EMF এর কারণে বর্তনীতে বিভব পার্থক্য সৃষ্টি হয়, যা ইলেকট্রনকে প্রবাহিত হতে সাহায্য করে এবং কারেন্ট তৈরি করে। ওহমের সূত্র (Ohm’s Law) অনুযায়ী, কারেন্ট (I) = EMF (E) / Resistance (R).
তড়িৎচালক বল নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- ইতালির বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা প্রথম ব্যাটারি তৈরি করেন এবং তড়িৎচালক বলের ধারণা দেন।
- আমাদের শরীরেও খুব সামান্য পরিমাণে EMF তৈরি হয়, যা নার্ভের মাধ্যমে সংবেদ (sensation) বহন করে।
- কিছু মাছ, যেমন ইলেকট্রিক ঈল (Electric Eel), শিকার ধরা ও আত্মরক্ষার জন্য শক্তিশালী EMF তৈরি করতে পারে।
ব্যবহারিক উদাহরণ: একটি বর্তনীর তড়িৎচালক বল নির্ণয়
ধরুন, আপনার কাছে একটি সার্কিট আছে যেখানে একটি ব্যাটারি, একটি রোধ (resistor) এবং একটি অ্যামিটার (Ammeter) যুক্ত আছে। অ্যামিটারটি 2 অ্যাম্পিয়ার (Ampere) কারেন্ট দেখাচ্ছে এবং রোধের মান 6 ওহম (Ohm)। এখন আপনি ব্যাটারির EMF বের করতে চান।
ওহমের সূত্র ব্যবহার করে আমরা জানি:
EMF (E) = কারেন্ট (I) x রোধ (R)
এখানে,
I = 2 অ্যাম্পিয়ার
R = 6 ওহম
সুতরাং,
E = 2 x 6 = 12 ভোল্ট
অতএব, ব্যাটারির EMF হলো 12 ভোল্ট।
তড়িৎচালক বল (EMF) সুরক্ষায় কিছু টিপস
যদিও EMF আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক সুবিধা এনেছে, অতিরিক্ত EMF এক্সপোজার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। নিচে কিছু টিপস দেওয়া হলো যা EMF থেকে আপনার সুরক্ষায় সাহায্য করতে পারে:
- মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় স্পিকারফোন বা হেডফোন ব্যবহার করুন, যাতে ফোন সরাসরি মাথার কাছে ধরতে না হয়।
- রাতে ঘুমানোর সময় মোবাইল ফোন বিছানা থেকে দূরে রাখুন।
- কম্পিউটার ব্যবহারের সময় স্ক্রিন থেকে适当Dদূরে বসুন এবং নিয়মিত বিরতি নিন।
- Wi-Fi রাউটার এবং অন্যান্য বেতার ডিভাইস শোবার ঘর থেকে দূরে রাখুন।
- সম্ভব হলে তারযুক্ত ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করুন, যা বেতার সংযোগের তুলনায় কম EMF নির্গত করে।
শেষ কথা
আশা করি, “তড়িৎচালক বল কাকে বলে” সেই প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে বোঝাতে পারলাম। তাহলে, আজ এই পর্যন্তই। ইলেক্ট্রনিক্সের দুনিয়ায় আরো অনেক মজার বিষয় আছে। জানতে থাকুন, শিখতে থাকুন, এবং অবশ্যই আমাদের সাথে থাকুন! আপনার যদি এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।