শুরুতেই একটা প্রশ্ন করি, রসায়ন ক্লাসে সেই বিকারের ছবিটা মনে আছে? যেখানে নানা রঙের দ্রবণ মিশিয়ে নতুন কিছু তৈরি করার চেষ্টা চলত? অনেকটা যেন জাদু! কিন্তু এই “জাদু”র পেছনে লুকিয়ে আছে কিছু হিসাব-নিকাশ। তেমনই একটা গুরুত্বপূর্ণ হিসাব হলো তুল্য ভর। তাহলে চলুন, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা জেনে নেই “তুল্য ভর কাকে বলে” এবং এর খুঁটিনাটি।
তুল্য ভর: রসায়নের হিসাব-নিকাশ
তুল্য ভর (Equivalent Weight) হলো একটি রাসায়নিক পদার্থের ভর, যা একটি হাইড্রোজেন পরমাণু (H), একটি ক্লোরিন পরমাণু (Cl), অথবা এক ইলেকট্রনের সাথে যুক্ত হতে বা প্রতিস্থাপন করতে পারে। শুনতে জটিল মনে হলেও, একটু ভেঙে বললেই বিষয়টা সহজ হয়ে যাবে।
তুল্য ভর কেন প্রয়োজন?
রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো সবসময় নির্দিষ্ট অনুপাতে ঘটে। এই অনুপাতটা বের করার জন্য তুল্য ভর জানা দরকার। ধরুন, আপনি একটি কেক বানাবেন। সেখানে যদি উপাদানের সঠিক অনুপাত না থাকে, তাহলে কেকটা হয়তো ভালো হবে না। তেমনি, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সঠিক ফল পেতে তুল্য ভর জানা জরুরি।
তুল্য ভর নির্ণয়ের সূত্র
তুল্য ভর বের করার বেশ কয়েকটি সূত্র আছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত সূত্রগুলো হলো:
- মৌলের তুল্য ভর = (মৌলের পারমাণবিক ভর) / (যোজ্যতা)
- অ্যাসিডের তুল্য ভর = (অ্যাসিডের আণবিক ভর) / (ক্ষারীয়তা)
- ** ক্ষারের তুল্য ভর = ( ক্ষারের আণবিক ভর) / (অম্লগ্রাহিতা)**
- লবণের তুল্য ভর = (লবণের আণবিক ভর) / (ধনাত্মক বা ঋণাত্মক চার্জের সংখ্যা)
- ** জারক/বিজারকের তুল্য ভর = (আণবিক ভর) / ( ইলেকট্রন সংখ্যা)**
ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমরা এই সূত্রগুলো নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করব।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুল্য ভর
তুল্য ভর শুধু একটি সংজ্ঞা নয়, এর ব্যবহারিক প্রয়োগ অনেক বেশি। বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
অ্যাসিড ও ক্ষারের তুল্য ভর
অ্যাসিড ও ক্ষারের তুল্য ভর তাদের আণবিক গঠন এবং বিক্রিয়ার ধরনের ওপর নির্ভর করে। একটি অ্যাসিডের ক্ষারীয়তা হলো সেই অ্যাসিডের প্রতি অণু যতগুলি প্রতিস্থাপনযোগ্য হাইড্রোজেন আয়ন (H+) থাকে তার সংখ্যা। অন্যদিকে, ক্ষারের অম্লগ্রাহিতা হলো সেই ক্ষারের প্রতি অণু যতগুলি হাইড্রোক্সাইড আয়ন (OH-) থাকে তার সংখ্যা।
হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCl)
হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের আণবিক ভর ৩৬.৫। এর ক্ষারীয়তা ১, কারণ এটি একটি হাইড্রোজেন আয়ন দান করতে পারে। সুতরাং, এর তুল্য ভর হবে:
তুল্য ভর = ৩৬.৫ / ১ = ৩৬.৫
সালফিউরিক অ্যাসিড (H₂SO₄)
সালফিউরিক অ্যাসিডের আণবিক ভর ৯৮। এর ক্ষারীয়তা ২, কারণ এটি দুটি হাইড্রোজেন আয়ন দান করতে পারে। সুতরাং, এর তুল্য ভর হবে:
তুল্য ভর = ৯৮ / ২ = ৪৯
সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH)
সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডের আণবিক ভর ৪০। এর অম্লগ্রাহিতা ১, কারণ এটি একটি হাইড্রোক্সাইড আয়ন দান করতে পারে। সুতরাং, এর তুল্য ভর হবে:
তুল্য ভর = ৪০ / ১ = ৪০
ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড (Ca(OH)₂)
ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইডের আণবিক ভর ৭৪। এর অম্লগ্রাহিতা ২, কারণ এটি দুইটি হাইড্রোক্সাইড আয়ন দান করতে পারে। সুতরাং, এর তুল্য ভর হবে:
তুল্য ভর = ৭৪ / ২ = ৩৭
জারক ও বিজারকের তুল্য ভর
জারক ও বিজারকের তুল্য ভর নির্ভর করে তারা কয়টি ইলেকট্রন গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে তার ওপর। জারক পদার্থ ইলেকট্রন গ্রহণ করে এবং বিজারক পদার্থ ইলেকট্রন বর্জন করে।
পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট (KMnO₄)
পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট একটি শক্তিশালী জারক পদার্থ। অ্যাসিড মাধ্যমে এটি ৫টি ইলেকট্রন গ্রহণ করে। এর আণবিক ভর ১৫৮। সুতরাং, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের তুল্য ভর হবে:
তুল্য ভর = ১৫৮ / ৫ = ৩১.৬
সোডিয়াম থায়োসালফেট (Na₂S₂O₃)
সোডিয়াম থায়োসালফেট বিজারক পদার্থ হিসেবে কাজ করে। এটি সাধারণত আয়োডিনের সাথে বিক্রিয়া করে এবং ২টি ইলেকট্রন বর্জন করে। এর আণবিক ভর ১৫৮। সুতরাং, সোডিয়াম থায়োসালফেটের তুল্য ভর হবে:
তুল্য ভর = ১৫৮ / ২ = ৭৯
লবণের তুল্য ভর
লবণের তুল্য ভর বের করতে লবণের আণবিক ভরকে ক্যাটায়ন বা অ্যানায়নের চার্জ সংখ্যা দিয়ে ভাগ করতে হয়।
সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl)
সোডিয়াম ক্লোরাইডের আণবিক ভর ৫৮.৫। এখানে সোডিয়াম (Na+) এর চার্জ +১ এবং ক্লোরাইড (Cl-) এর চার্জ -১। সুতরাং, এর তুল্য ভর হবে:
তুল্য ভর = ৫৮.৫ / ১ = ৫৮.৫
ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড (CaCl₂)
ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডের আণবিক ভর ১১১। এখানে ক্যালসিয়াম (Ca2+) এর চার্জ +২ এবং ক্লোরাইড (Cl-) এর চার্জ -১ (কিন্তু দুইটি ক্লোরাইড আয়ন আছে)। সুতরাং, এর তুল্য ভর হবে:
তুল্য ভর = ১১১ / ২ = ৫৫.৫
তুল্য ভর এবং মোলার ভর এর মধ্যে সম্পর্ক
তুল্য ভর এবং মোলার ভর (Molar mass) এর মধ্যে একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে। মোলার ভর হলো কোনো পদার্থের এক মোলের ভর, যা গ্রাম এককে প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে, তুল্য ভর হলো সেই পদার্থের কতটুকু ভর একটি হাইড্রোজেন পরমাণু বা একটি ইলেকট্রনের সাথে যুক্ত হতে পারে। নিচে সম্পর্কটি দেওয়া হলো:
- তুল্য ভর = মোলার ভর / n
এখানে, n হলো যোজ্যতা, ক্ষারীয়তা, অম্লগ্রাহিতা অথবা ইলেকট্রন সংখ্যা।
“তুল্য ভর কাকে বলে” – কিছু উদাহরণ
বিষয়টা আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক:
-
ধরা যাক, অ্যালুমিনিয়ামের (Al) পারমাণবিক ভর ২৭ এবং এর যোজ্যতা ৩। তাহলে অ্যালুমিনিয়ামের তুল্য ভর হবে:
তুল্য ভর = ২৭ / ৩ = ৯
অর্থাৎ, অ্যালুমিনিয়ামের ৯ গ্রাম একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে যুক্ত হতে পারে।
-
সালফিউরিক অ্যাসিড (H₂SO₄) এর আণবিক ভর ৯৮ এবং এর ক্ষারীয়তা ২। তাহলে সালফিউরিক অ্যাসিডের তুল্য ভর হবে:
তুল্য ভর = ৯৮ / ২ = ৪৯
এর মানে হলো, সালফিউরিক অ্যাসিডের ৪৯ গ্রাম একটি ক্ষারের সাথে বিক্রিয়া করে লবণ ও পানি উৎপন্ন করতে পারে।
-
ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড (CaCl₂) এর আণবিক ভর ১১১। এখানে ক্যালসিয়াম (Ca2+) এর চার্জ +২। সুতরাং, এর তুল্য ভর হবে:
তুল্য ভর = ১১১ / ২ = ৫৫.৫
তুল্য ভর নির্ণয়ের গুরুত্ব
রসায়নের বিভিন্ন হিসাব-নিকাশে তুল্য ভর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক নিচে উল্লেখ করা হলো:
- টাইট্রেশন: টাইট্রেশন প্রক্রিয়ায় অজানা দ্রবণের ঘনমাত্রা নির্ণয় করতে তুল্য ভর ব্যবহার করা হয়।
- ভারসাম্য রক্ষা: রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কোন পদার্থ কতটুকু প্রয়োজন, তা জানতে তুল্য ভর সাহায্য করে।
- রাসায়নিক গণনা: বিভিন্ন রাসায়নিক গণনা, যেমন – মোলারিটি, নরমালিটি ইত্যাদি বের করতে তুল্য ভর দরকার হয়।
কিছু জটিল উদাহরণ
যদি কোনো বিক্রিয়ায় একটি জারক বা বিজারক একাধিক উৎপাদ তৈরি করে তবে তুল্য ভর হিসাব করা একটু জটিল হতে পারে। সেক্ষেত্রে, কোন উৎপাদ তৈরি হচ্ছে এবং কয়টি ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে তুল্য ভর নির্ণয় করতে হয়।
ধরা যাক, কোনো একটি বিক্রিয়ায় পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট (KMnO₄) বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন উৎপাদ তৈরি করে। যেমন:
- আল্কলাইন মাধ্যমে: KMnO₄ → MnO₂ (এখানে ইলেকট্রন পরিবর্তন ৩)
- নিরপেক্ষ মাধ্যমে: KMnO₄ → MnO₂ (এখানে ইলেকট্রন পরিবর্তন ৩)
- অম্লীয় মাধ্যমে: KMnO₄ → Mn2+ (এখানে ইলেকট্রন পরিবর্তন ৫)
সুতরাং, প্রতিটি মাধ্যমের জন্য তুল্য ভর ভিন্ন হবে।
শেষ কথা
“তুল্য ভর কাকে বলে” – আশা করি, এই প্রশ্নের উত্তর আপনারা পেয়েছেন। রসায়নের জটিল হিসাব-নিকাশকে সহজ করার জন্য তুল্য ভর একটি অপরিহার্য ধারণা। তাই, এটি ভালোভাবে বোঝা জরুরি।
রসায়ন এমন একটা বিষয়, যা শুধু মুখস্থ করে মনে রাখা যায় না। এর জন্য দরকার নিয়মিত অনুশীলন এবং গভীর মনোযোগ। আপনি যদি রসায়নের এই বিষয়গুলো আরও ভালোভাবে জানতে চান, তাহলে অবশ্যই আমাদের সাথে থাকুন। আর কোনো প্রশ্ন থাকলে, নির্দ্বিধায় কমেন্ট করুন!