আচ্ছা, ধরুন তো, আপনি আর আমি মিলে একটা নতুন ব্যবসা শুরু করতে চাইছি। কারো কাছে হয়তো পর্যাপ্ত মূলধন আছে, কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব। আবার কারো হয়তো অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু পুঁজি নেই। তখন কী হবে? আমাদের চেষ্টা থাকবে ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়া। উন্নয়নশীল দেশগুলোও অনেকটা তেমনই!
উন্নয়নশীল দেশ কাকে বলে? চলুন, আজ আমরা এই বিষয়টি নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা করি।
উন্নয়নশীল দেশ: উন্নয়নের পথে অগ্রযাত্রা
উন্নয়নশীল দেশ (Developing Country) বলতে সাধারণত সেইসব দেশকে বোঝানো হয়, যারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে। এই দেশগুলো এখনো তাদের নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, উন্নয়নের পথে আসা নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
উন্নয়নশীল দেশের বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী?
উন্নয়নশীল দেশ চেনার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এগুলো দেখলেই বোঝা যায়, একটি দেশ উন্নয়নের পথে হাঁটছে কিনা। নিচে কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:
নিম্ন মাথাপিছু আয়
মাথাপিছু আয় (Per Capita Income) একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচক। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মাথাপিছু আয় উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। এর মানে হলো, একজন গড় নাগরিকের আয় কম হওয়ার কারণে জীবনযাত্রার মান উন্নত হতে বেশ বেগ পেতে হয়।
দারিদ্র্যের উচ্চ হার
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র্যের হার অনেক বেশি। একটা বড় সংখ্যক মানুষ তাদের মৌলিক চাহিদা, যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা পূরণে অক্ষম।
দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা
এসব দেশে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত দেশগুলোর মতো নয়। ভালো হাসপাতাল, অভিজ্ঞ ডাক্তার, নার্স এবং প্রয়োজনীয় ঔষধের অভাব প্রায়ই দেখা যায়। এর ফলে শিশুমৃত্যুর হার বেশি এবং গড় আয়ু কম হয়।
শিক্ষার অভাব
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে কম। অনেক শিশুই স্কুলে যেতে পারে না, আবার অনেকে মাধ্যমিক স্তরের আগেই ঝরে পড়ে। শিক্ষার অভাবের কারণে দক্ষ জনশক্তিরও অভাব দেখা যায়।
কৃষি নির্ভর অর্থনীতি
অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি কৃষির উপর নির্ভরশীল। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কম হওয়ায় কৃষির উৎপাদনশীলতাও তুলনামূলকভাবে কম থাকে।
অপর্যাপ্ত অবকাঠামো
রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানি, যোগাযোগ ব্যবস্থা – এগুলো একটি দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায়ই এই অবকাঠামোগুলোর অভাব দেখা যায়। দুর্বল অবকাঠামোর কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি
অনেক উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং সুশাসনের অভাব দেখা যায়। এসব কারণে বিনিয়োগ কম হয় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
কী কী কারণে একটি দেশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত হতে পারে না?
উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নত দেশ হতে না পারার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। কয়েকটি প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
colonialism বা উপনিবেশবাদ অনেক দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি শাসনের ফলে স্থানীয় শিল্প এবং বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি বড় বাধা। এসব দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর প্রচুর ক্ষতি হয়, যা উন্নয়নের গতিকে কমিয়ে দেয়।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি
উচ্চ জনসংখ্যা বৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার উপর চরম চাপ সৃষ্টি হয়।
প্রযুক্তিগত দুর্বলতা
উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক কম। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা ও উন্নয়নের অভাব রয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের পথে কী কী বাধা রয়েছে?
উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের পথে অনেক বাধা বিদ্যমান। নিচে কয়েকটি প্রধান বাধা নিয়ে আলোচনা করা হলো:
অর্থনৈতিক বাধা
- মূলধনের অভাব: উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব রয়েছে।
- বৈদেশিক ঋণের বোঝা: অনেক দেশ বিদেশি ঋণের বোঝায় জর্জরিত, যা উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা।
- বিশ্ব বাজারের অস্থিরতা: বিশ্ব বাজারের অস্থিরতা এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত জটিলতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে।
সামাজিক বাধা
- লিঙ্গ বৈষম্য: অনেক উন্নয়নশীল দেশে নারীরা শিক্ষা, চাকরি এবং অন্যান্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
- জাতিগত সংঘাত: জাতিগত সংঘাত এবং সামাজিক বিভাজন উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
- কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদ চিন্তা: কুসংস্কার এবং পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনা সমাজে উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
রাজনৈতিক বাধা
- রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা দেয়।
- দুর্নীতি: দুর্নীতি উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। দুর্নীতির কারণে সরকারি সম্পদ অপচয় হয় এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাধাগ্রস্ত হয়।
- সুশাসনের অভাব: সুশাসনের অভাবে আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিনিয়োগের পরিবেশ নষ্ট হয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদাহরণ
বিশ্বে অনেক দেশ আছে, যারা উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় পড়ে। এদের মধ্যে কয়েকটির উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
- বাংলাদেশ
- ভারত
- ভিয়েতনাম
- নাইজেরিয়া
- মিশর
- পাকিস্তান
- কেনিয়া
উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কীভাবে উন্নত করা যেতে পারে?
উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত করার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিচে আলোচনা করা হলো:
অর্থনৈতিক উন্নয়ন
- বিনিয়োগ বৃদ্ধি: দেশে ও বিদেশে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে।
- শিল্পায়ন: নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন এবং পুরনো শিল্পগুলোর আধুনিকীকরণ করতে হবে।
- বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি: রপ্তানি বাড়ানোর জন্য নতুন বাজার খুঁজতে হবে এবং বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে।
মানবাধিকার উন্নয়ন
- শিক্ষার বিস্তার: শিক্ষার মান বাড়াতে হবে এবং শিক্ষাকে সবার জন্য সহজলভ্য করতে হবে।
- স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন: আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে এবং স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
- দারিদ্র্য বিমোচন: দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করতে হবে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন
- সুশাসন প্রতিষ্ঠা: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং দুর্নীতি কমাতে হবে।
- আইনের শাসন: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশ এবং উন্নত দেশের মধ্যে পার্থক্য কী?
উন্নয়নশীল দেশ এবং উন্নত দেশের মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নিচে প্রধান পার্থক্যগুলো তুলে ধরা হলো:
বৈশিষ্ট্য | উন্নয়নশীল দেশ | উন্নত দেশ |
---|---|---|
মাথাপিছু আয় | কম | বেশি |
দারিদ্র্যের হার | বেশি | কম |
স্বাস্থ্যসেবা | দুর্বল | উন্নত |
শিক্ষার হার | কম | বেশি |
শিল্পায়ন | কম | বেশি |
অবকাঠামো | দুর্বল | উন্নত |
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা | কম | বেশি |
Frequently Asked Questions (FAQs)
উন্নয়নশীল দেশ নিয়ে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। তেমনই কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তার উত্তর নিচে দেওয়া হলো:
উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার অভাব, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং দুর্নীতি। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করাও তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কীভাবে সাহায্য করতে পারে?
জাতিসংঘ (UN), বিশ্বব্যাংক (World Bank), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আর্থিক সহায়তা, কারিগরি সহায়তা এবং নীতি নির্ধারণে সাহায্য করতে পারে। তারা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও সাহায্য করে থাকে।
উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে উত্তরণের পথে বাংলাদেশ কতদূর এগিয়েছে?
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের কথা রয়েছে। তবে, উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগের সুযোগগুলো কী কী?
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প, কৃষি, প্রযুক্তি এবং পর্যটন খাতে বিনিয়োগের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এসব দেশে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে COVID-19 মহামারীর প্রভাব কেমন ছিল?
COVID-19 মহামারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। তবে, অনেক দেশ এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিবেশ সুরক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
পরিবেশ সুরক্ষায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো, বনভূমি রক্ষা করা, দূষণ কমানো এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করা। এছাড়া, পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষার মানোন্নয়নে কী করা যায়?
শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজন শিক্ষক প্রশিক্ষণ, আধুনিক শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইন শিক্ষার প্রসার ঘটানো যেতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব কী?
সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে দুর্নীতি কমে যায়, বিনিয়োগ বাড়ে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুত হয়। এছাড়া, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষের অধিকার সুরক্ষিত থাকে।
পরিশেষে বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নতির পথে অনেক বাধা থাকলেও সম্ভাবনাও প্রচুর। সঠিক পরিকল্পনা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই দেশগুলো উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হতে পারে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে একটি সুন্দর ও উন্নত ভবিষ্যৎ গড়তে।