আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? ভাবছেন তো আজ আবার ব্যাকরণ নিয়ে কেন বসলাম? আসলে, ভাষা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আর ক্রিয়া (verb) হলো সেই ভাষার প্রাণভোমরা! ক্রিয়া ছাড়া একটি বাক্যও কল্পনা করা যায় না। তাই, ক্রিয়া কী, কত প্রকার, আর এর খুঁটিনাটি সবকিছু নিয়েই আজকের আলোচনা। তাহলে চলুন, দেরি না করে শুরু করা যাক!
ক্রিয়া—নামটা শুনলেই মনে হয়, কিছু করা! হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। কোনো কাজ করা বোঝানোই হলো ক্রিয়ার মূল কাজ।
ক্রিয়া কাকে বলে?
সহজ ভাষায়, যে শব্দ দিয়ে কোনো কাজ করা, হওয়া, বা ঘটা বোঝায়, তাকে ক্রিয়া বলে। মানে, আপনি যা করছেন, আমি যা বলছি, পাখি যা উড়ছে—এগুলো সবই ক্রিয়া।
ক্রিয়ার একটি সহজ উদাহরণ
ধরুন, আপনি এখন এই ব্লগ পোস্টটি পড়ছেন। এখানে “পড়ছেন” শব্দটি একটি ক্রিয়া। কারণ, এটি আপনার একটি কাজ করা বোঝাচ্ছে। একইভাবে, “আমি লিখছি” এখানে “লিখছি” ক্রিয়া।
ক্রিয়া কত প্রকার ও কি কি?
ক্রিয়াকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। এদের মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাগ নিচে আলোচনা করা হলো:
কর্মের ভিত্তিতে ক্রিয়া
কর্ম মানে হলো object। একটি বাক্যে ক্রিয়াটি কোনোকিছুর উপর কাজ করছে কিনা, তার উপর ভিত্তি করে এই ভাগগুলো করা হয়েছে।
সকর্মক ক্রিয়া (Transitive Verb)
যে ক্রিয়ার কর্ম (object) থাকে, তাকে সকর্মক ক্রিয়া বলে। অর্থাৎ, ক্রিয়াটি কাজ করার সময় কোনো কিছুর উপর নির্ভর করে।
- উদাহরণ:
- আমি ভাত খাচ্ছি। (এখানে “ভাত” হলো কর্ম)
- সে বই পড়ছে। (এখানে “বই” হলো কর্ম)
- তারা গান গাইছে। (এখানে “গান” হলো কর্ম)
অকর্মক ক্রিয়া (Intransitive Verb)
যে ক্রিয়ার কর্ম (object) থাকে না, তাকে অকর্মক ক্রিয়া বলে। অর্থাৎ, ক্রিয়াটি স্বাধীনভাবে সম্পন্ন হয়, কোনো কিছুর উপর নির্ভর করে না।
- উদাহরণ:
- আমি যাচ্ছি।
- সে ঘুমাচ্ছে।
- পাখি উড়ছে।
দ্বিকর্মক ক্রিয়া (Ditransitive Verb)
যে ক্রিয়ার দুটি কর্ম (object) থাকে, তাকে দ্বিকর্মক ক্রিয়া বলে।
-
প্রাণীবাবচক কর্ম (“কাকে”) – গৌণ কর্ম
-
বস্তুবাচক কর্ম (“কি”) – মুখ্য কর্ম
-
উদাহরণ:
- বাবা আমাকে একটি কলম দিলেন। (এখানে “আমাকে” এবং “কলম” দুটি কর্ম)
- শিক্ষক ছাত্রদের ব্যাকরণ পড়াচ্ছেন। (এখানে “ছাত্রদের” এবং “ব্যাকরণ” দুটি কর্ম)
- মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন। (এখানে “শিশুকে” এবং “চাঁদ” দুটি কর্ম)
গঠন অনুসারে ক্রিয়া
ক্রিয়া কিভাবে গঠিত হয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে এই প্রকারভেদ।
সাধিত ক্রিয়া
মৌলিক বা নাম শব্দের পরে প্রত্যয় যোগ করে যে ক্রিয়া গঠিত হয়, তাকে সাধিত ক্রিয়া বলে।
- উদাহরণ:
- দেখা > দেখাও
- বলা > বলাও
- ঘুমা > ঘুমাও
যৌগিক ক্রিয়া
একটি সমাপিকা ক্রিয়ার সাথে অন্য একটি অসমাপিকা ক্রিয়া যুক্ত হয়ে যদি একটি বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে।
- উদাহরণ:
- তিনি যেতে লাগলেন।
- সাইরেন বেজে উঠল।
- বৃষ্টি আসতে পারে।
অর্থের ভিত্তিতে ক্রিয়া
ক্রিয়াটি বাক্যে কী অর্থ প্রকাশ করছে, তার উপর ভিত্তি করে এই ভাগগুলো করা হয়েছে।
সমাপিকা ক্রিয়া (Finite Verb)
যে ক্রিয়া দ্বারা বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়, তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে। অর্থাৎ, এই ক্রিয়াটি ব্যবহার করার পরে বাক্যের অর্থ বোঝার জন্য অন্য কোনো শব্দের উপর নির্ভর করতে হয় না।
- উদাহরণ:
- আমি ভাত খাই।
- সে বই পড়ে।
- তারা গান গায়।
অসমাপিকা ক্রিয়া (Non-finite Verb)
যে ক্রিয়া দ্বারা বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায় না, তাকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে। এই ক্রিয়া ব্যবহার করার পরে বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ করার জন্য আরো শব্দের প্রয়োজন হয়।
- উদাহরণ:
- আমি খেতে যাই।
- সে পড়তে বসে।
- তারা গাইতে এল।
সকর্মক ও অকর্মক ক্রিয়া চেনার সহজ উপায়
সকর্মক ক্রিয়া চেনার জন্য ক্রিয়াকে “কী” বা “কাকে” দিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায়। অকর্মক ক্রিয়াতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যায় না।
- আমি কি খাই? উত্তর: ভাত। (সকর্মক)
- সে কি পড়ে? উত্তর: বই। (সকর্মক)
- তারা কি গায়? উত্তর: গান। (সকর্মক)
- আমি কি যাই? উত্তর নেই। (অকর্মক)
- সে কি ঘুমায়? উত্তর নেই। (অকর্মক)
- পাখি কি উড়ে? উত্তর নেই। (অকর্মক)
অন্যান্য প্রকারভেদ
এছাড়াও আরও কিছু প্রকারভেদ রয়েছে, যেগুলো আমাদের প্রায়শই প্রয়োজন হয়।
প্রযোজক ক্রিয়া
যখন কোনো কর্তা নিজে কাজ না করে অন্যকে দিয়ে করায়, তখন সেই ক্রিয়াকে প্রযোজক ক্রিয়া বলে।
- উদাহরণ:
- মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন।
- শিক্ষক ছাত্রদের ব্যাকরণ পড়াচ্ছেন।
নামধাতুর ক্রিয়া
বিশেষ্য, বিশেষণ বা ধ্বন্যাত্মক শব্দের পরে ক্রিয়া বিভক্তি যুক্ত হয়ে যে ক্রিয়া গঠিত হয়, তাকে নামধাতুর ক্রিয়া বলে।
- উদাহরণ:
- বেত > বেতাও
- ঘুম > ঘুমাও
ক্রিয়া পদের উদাহরণ
নিচে কয়েকটি ক্রিয়া পদের উদাহরণ দেওয়া হলো:
- যাওয়া
- খাওয়া
- দেখা
- বলা
- করা
- হওয়া
- থাকা
- ঘুমানো
- ওড়া
- দৌড়ানো
ক্রিয়া নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- বাংলা ভাষায় ক্রিয়ার রূপ পরিবর্তন হয়, যা কাল (Tense) এবং পুরুষ (Person) ভেদে ভিন্ন হয়।
- ক্রিয়া ছাড়া কোনো বাক্য তৈরি করা সম্ভব নয়।
- ক্রিয়া একটি বাক্যের প্রাণ এবং এটি ছাড়া বাক্যের অর্থ অসম্পূর্ণ থাকে।
কিছু সাধারণ ভুল এবং সেগুলি থেকে মুক্তির উপায়
আমরা প্রায়ই ক্রিয়া ব্যবহারের সময় কিছু ভুল করে থাকি। নিচে কয়েকটি সাধারণ ভুল এবং সেগুলি থেকে মুক্তির উপায় আলোচনা করা হলো:
- ভুল: আমি ভাত খাচ্ছি, কিন্তু সে খাচ্ছে না। (এখানে “খাচ্ছে” শব্দটি দুইবার ব্যবহার করা হয়েছে)
- সঠিক: আমি ভাত খাচ্ছি, কিন্তু সে খায় না।
- ভুল: সে কালকে আসবে। (এখানে “কালকে” শব্দটি ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে)
- সঠিক: সে কাল আসবে।
- ভুল: আমি এটা করতে পারব না মনে হয়। (এখানে “মনে হয়” ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই)
- সঠিক: আমি এটা করতে পারব না।
ক্রিয়া ব্যবহারের নিয়ম
ক্রিয়া ব্যবহারের কিছু সাধারণ নিয়ম নিচে দেওয়া হলো:
- কর্তা অনুসারে ক্রিয়ার রূপ পরিবর্তন হয়।
- কাল (Tense) অনুসারে ক্রিয়ার রূপ পরিবর্তন হয়।
- বাক্যের অর্থ অনুসারে ক্রিয়া নির্বাচন করতে হয়।
ক্রিয়া চেনার সহজ উপায়
ক্রিয়া চেনার জন্য আপনি নিম্নলিখিত উপায়গুলো অবলম্বন করতে পারেন:
- বাক্যে কোনো কাজ করা বোঝাচ্ছে কিনা, তা দেখুন।
- “কী” বা “কাকে” দিয়ে প্রশ্ন করে দেখুন উত্তর পাওয়া যায় কিনা।
- ক্রিয়া পদের শেষে সাধারণত “আ”, “তে”, “বে”, “ছেন” ইত্যাদি যুক্ত থাকে।
ক্রিয়া এবং অন্যান্য পদের মধ্যে পার্থক্য
বাক্যে বিভিন্ন পদ থাকে, যেমন—বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, অব্যয় এবং ক্রিয়া। এদের মধ্যে ক্রিয়া পদটি কাজ করা বোঝায়, যেখানে অন্য পদগুলো বিশেষ্য, গুণাগুণ বা সম্পর্ক বোঝায়।
ক্রিয়ার গুরুত্ব
বাংলা ভাষায় ক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু একটি পদ নয়, এটি বাক্যের প্রাণ। ক্রিয়া ছাড়া কোনো বাক্য সম্পূর্ণরূপে অর্থ প্রকাশ করতে পারে না। তাই, বাংলা ভাষা ভালোভাবে জানতে এবং ব্যবহার করতে হলে ক্রিয়ার সঠিক ব্যবহার জানা অত্যন্ত জরুরি।
ক্রিয়া নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
ক্রিয়া নিয়ে আপনাদের মনে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। তাই, নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
ক্রিয়া কাকে বলে উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা করুন।
যে শব্দ দিয়ে কোনো কাজ করা, হওয়া বা ঘটা বোঝায়, তাকে ক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: আমি বই পড়ছি। এখানে “পড়ছি” শব্দটি একটি ক্রিয়া।
ক্রিয়া কত প্রকার ও কি কি?
ক্রিয়া প্রধানত দুই প্রকার: সমাপিকা ক্রিয়া ও অসমাপিকা ক্রিয়া। এছাড়াও, কর্মের ভিত্তিতে সকর্মক, অকর্মক ও দ্বিকর্মক ক্রিয়া এবং গঠনের ভিত্তিতে মৌলিক ও যৌগিক ক্রিয়া রয়েছে।
সকর্মক ক্রিয়া কাকে বলে উদাহরণ দিন।
যে ক্রিয়ার কর্ম (object) থাকে, তাকে সকর্মক ক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: আমি ভাত খাচ্ছি। এখানে “ভাত” হলো কর্ম।
অকর্মক ক্রিয়া কাকে বলে উদাহরণ দিন।
যে ক্রিয়ার কর্ম (object) থাকে না, তাকে অকর্মক ক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: আমি যাচ্ছি।
সমাপিকা ক্রিয়া কাকে বলে উদাহরণ দিন।
যে ক্রিয়া দ্বারা বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায় তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: আমি ভাত খাই।
অসমাপিকা ক্রিয়া কাকে বলে উদাহরণ দিন।
যে ক্রিয়া দ্বারা বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায় না তাকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: আমি খেতে যাই।
যৌগিক ক্রিয়া কাকে বলে?
একটি সমাপিকা ক্রিয়ার সাথে অন্য একটি অসমাপিকা ক্রিয়া যুক্ত হয়ে যদি একটি বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: তিনি যেতে লাগলেন।
প্রযোজক ক্রিয়া কাকে বলে?
যখন কোনো কর্তা নিজে কাজ না করে অন্যকে দিয়ে করায়, তখন সেই ক্রিয়াকে প্রযোজক ক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন।
ধাতু ও ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য কি?
ধাতু হলো ক্রিয়ার মূল অংশ। ক্রিয়া তৈরির জন্য ধাতুর সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন, “যাওয়া” ক্রিয়ার মূল ধাতু হলো “যা”।
নামধাতুর ক্রিয়া কাকে বলে?
বিশেষ্য, বিশেষণ বা ধ্বন্যাত্মক শব্দের পরে ক্রিয়া বিভক্তি যুক্ত হয়ে যে ক্রিয়া গঠিত হয়, তাকে নামধাতুর ক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: বেত > বেতাও
শেষ কথা
আশা করি, ক্রিয়া নিয়ে আপনার মনে আর কোনো প্রশ্ন নেই। ক্রিয়া বাংলা ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং এর সঠিক ব্যবহার আপনার ভাষাজ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করবে। নিয়মিত চর্চা করুন এবং নতুন নতুন বাক্য তৈরি করার চেষ্টা করুন। আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ!