আজকে আমরা কথা বলবো একটা খুব দরকারি বিষয় নিয়ে – অভ্যন্তরীণ রোধ (Internal Resistance). দৈনন্দিন জীবনে ব্যাটারি বা কোষ ব্যবহার করার সময় নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, ব্যাটারি নতুন থাকলে যেমন আলো দেয়, পুরনো হতে থাকলে তেমন দেয় না। এমনকি, কিছু সময় পর একদমই দেয় না! এর পেছনে অভ্যন্তরীণ রোধের একটা বড় ভূমিকা আছে। তাহলে চলুন, দেরি না করে জেনে নিই এই অভ্যন্তরীণ রোধ আসলে কী, কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ, এবং কীভাবে এটা আমাদের ব্যবহার করা ডিভাইসগুলোর কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে।
অভ্যন্তরীণ রোধ (Internal Resistance) কাকে বলে?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অভ্যন্তরীণ রোধ হলো কোনো তড়িৎ উৎসের (যেমন ব্যাটারি বা জেনারেটর) ভেতরের উপাদানের কারণে তড়িৎ প্রবাহে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা। ব্যাটারির ভেতরে ইলেকট্রোলাইট এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যেগুলোর মধ্য দিয়ে কারেন্ট যাওয়ার সময় কিছু পরিমাণ বাধার সম্মুখীন হয়। এই বাধাই হলো অভ্যন্তরীণ রোধ।
বিষয়টা একটু খোলসা করে বলা যাক। ধরুন, আপনি একটা নদীর ভেতর দিয়ে সাঁতরে পার হতে চাইছেন। নদীর জল যদি স্থির থাকে, তাহলে সাঁতরাতে সুবিধা হবে। কিন্তু যদি স্রোত থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই বেশি শক্তি খরচ হবে, কারণ স্রোত আপনার গতির বিরুদ্ধে একটা বাধা দেবে। অভ্যন্তরীণ রোধ অনেকটা তেমনই। ব্যাটারির ভেতরে যখন কারেন্ট চলে, তখন ব্যাটারির ভেতরের উপাদানগুলো কারেন্টের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
আরও একটু অন্যভাবে ভাবা যাক। আপনি একটা টিউবওয়েল থেকে জল তুলছেন। টিউবওয়েলের পাইপটা যদি একদম নতুন আর পরিষ্কার থাকে, তাহলে জল সহজে উঠবে। কিন্তু পাইপের ভেতরে যদি ময়লা জমে থাকে, তাহলে জল তুলতে কষ্ট হবে, কারণ ময়লা জলের প্রবাহে বাধা দেবে। ব্যাটারির অভ্যন্তরীণ রোধ অনেকটা সেই ময়লার মতো, যা কারেন্ট প্রবাহে বাধা দেয়।
অভ্যন্তরীণ রোধ কেন হয়?
অভ্যন্তরীণ রোধের কারণগুলো বেশ কয়েকটা। নিচে কয়েকটি প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো:
- ইলেকট্রোলাইটের রোধ: ব্যাটারির ভেতরে যে ইলেকট্রোলাইট দ্রবণ থাকে, তার একটা নিজস্ব রোধ আছে। এই রোধ কারেন্ট চলাচলে বাধা দেয়।
- তড়িৎদ্বারের ( electrodes) রোধ : ব্যাটারির তড়িৎদ্বারগুলো যে পদার্থ দিয়ে তৈরি, সেগুলোরও রোধ থাকে। এই রোধও কারেন্ট প্রবাহকে বাধা দেয়।
- রাসায়নিক বিক্রিয়া: ব্যাটারির ভেতরে রাসায়নিক বিক্রিয়া চলার সময় কিছু বাধা সৃষ্টি হয়, যা অভ্যন্তরীণ রোধের কারণ হতে পারে।
- পুরনো ব্যাটারি: পুরনো ব্যাটারির ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে ইলেকট্রোলাইট শুকিয়ে যায় বা এর কার্যকারিতা কমে যায়, যার ফলে অভ্যন্তরীণ রোধ বেড়ে যায়।
অভ্যন্তরীণ রোধের একক কি?
অভ্যন্তরীণ রোধ পরিমাপ করার একক হলো ওহম (Ohm), যাকে গ্রিক অক্ষর ওমেগা (Ω) দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
অভ্যন্তরীণ রোধের প্রভাব
অভ্যন্তরীণ রোধের বেশ কিছু খারাপ প্রভাব আছে। নিচে কয়েকটি প্রধান প্রভাব আলোচনা করা হলো:
- ভোল্টেজ ড্রপ: অভ্যন্তরীণ রোধের কারণে ব্যাটারির টার্মিনালে ভোল্টেজ কমে যায়। আপনি হয়তো জানেন, ব্যাটারির গায়ে লেখা থাকে 1.5V বা 3.7V, কিন্তু যখন ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়, তখন মাল্টিমিটার দিয়ে মেপে দেখলে দেখা যায় ভোল্টেজ তার থেকে কম। এর কারণ হলো অভ্যন্তরীণ রোধের কারণে কিছু ভোল্টেজ ভেতরেই ড্রপ হয়ে যায়।
- কারেন্ট সরবরাহ কমে যাওয়া: অভ্যন্তরীণ রোধ বেশি হলে ব্যাটারি থেকে পর্যাপ্ত কারেন্ট পাওয়া যায় না। ফলে, ডিভাইস ঠিকমতো কাজ করতে পারে না বা ধীরে চলে।
- ব্যাটারির কার্যকারিতা হ্রাস: অভ্যন্তরীণ রোধের কারণে ব্যাটারির কর্মক্ষমতা কমে যায় এবং এটি দ্রুত ডিসচার্জ হয়ে যায়।
অভ্যন্তরীণ রোধ কিভাবে মাপা হয়?
অভ্যন্তরীণ রোধ সরাসরি মাপা একটু কঠিন, তবে কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে এটি পরিমাপ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে সহজ এবং বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি হলো ভোল্টেজ ড্রপ মেথড (Voltage Drop Method)। এই পদ্ধতিতে, ব্যাটারির ওপর একটি নির্দিষ্ট লোড (resistance) প্রয়োগ করে ভোল্টেজ এবং কারেন্ট পরিমাপ করা হয়। তারপর ওহমের সূত্র ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ রোধ নির্ণয় করা হয়।
এখানে সূত্রটি হলো:
r = (E – V) / I
যেখানে,
- r = অভ্যন্তরীণ রোধ
- E = খোলা বর্তনীর ভোল্টেজ (Open Circuit Voltage)
- V = লোডযুক্ত অবস্থায় ভোল্টেজ (Terminal Voltage)
- I = কারেন্ট
এছাড়াও, কিছু আধুনিক মাল্টিমিটারে অভ্যন্তরীণ রোধ মাপার জন্য বিশেষ ফাংশন থাকে।
অভ্যন্তরীণ রোধ কমানোর উপায়
যদিও অভ্যন্তরীণ রোধ একেবারে কমানো সম্ভব নয়, তবে কিছু উপায়ে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়:
- ভালো মানের ব্যাটারি ব্যবহার: ভালো মানের ব্যাটারির অভ্যন্তরীণ রোধ সাধারণত কম থাকে।
- নিয়মিত ব্যবহার: ব্যাটারি নিয়মিত ব্যবহার করলে এর কর্মক্ষমতা ভালো থাকে এবং অভ্যন্তরীণ রোধ বাড়তে পারে না।
- সঠিক তাপমাত্রা: খুব বেশি গরম বা ঠান্ডা তাপমাত্রায় ব্যাটারি রাখলে এর অভ্যন্তরীণ রোধ বেড়ে যেতে পারে। তাই, ব্যাটারিকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা উচিত।
- সঠিকভাবে চার্জ দেওয়া: ব্যাটারিকে সবসময় সঠিক চার্জার দিয়ে চার্জ করা উচিত। ভুল চার্জার ব্যবহার করলে ব্যাটারির ক্ষতি হতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ রোধ বেড়ে যেতে পারে।
অভ্যন্তরীণ রোধের ব্যবহারিক উদাহরণ
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অভ্যন্তরীণ রোধের অনেক উদাহরণ রয়েছে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
- মোবাইল ফোন: পুরনো মোবাইলে ব্যাটারি দ্রুত শেষ হয়ে যায়, কারণ ব্যাটারির অভ্যন্তরীণ রোধ বেড়ে যায়।
- রিমোট কন্ট্রোল: রিমোটের ব্যাটারি দুর্বল হয়ে গেলে রিমোট ঠিকমতো কাজ করে না, কারণ ব্যাটারির অভ্যন্তরীণ রোধ বেড়ে যায়।
- গাড়ির ব্যাটারি: গাড়ির ব্যাটারি পুরনো হয়ে গেলে গাড়ি স্টার্ট হতে সমস্যা হয়, কারণ ব্যাটারির অভ্যন্তরীণ রোধ বেড়ে যায়।
অভ্যন্তরীণ রোধ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQs)
এখানে অভ্যন্তরীণ রোধ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
প্রশ্ন: অভ্যন্তরীণ রোধ কি ব্যাটারির আয়ু কমিয়ে দেয়?
উত্তর: হ্যাঁ, অভ্যন্তরীণ রোধ বাড়লে ব্যাটারির কার্যকারিতা কমে যায় এবং এটি দ্রুত ডিসচার্জ হয়ে যায়, যা ব্যাটারির আয়ু কমিয়ে দেয়।
প্রশ্ন: সব ব্যাটারির কি অভ্যন্তরীণ রোধ থাকে?
উত্তর: হ্যাঁ, সব ব্যাটারিরই কিছু না কিছু অভ্যন্তরীণ রোধ থাকে। এটি ব্যাটারির একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য।
প্রশ্ন: অভ্যন্তরীণ রোধ তাপমাত্রা কিভাবে প্রভাবিত হয়?
উত্তর: সাধারণত, তাপমাত্রা বাড়লে অভ্যন্তরীণ রোধ কমে যায় এবং তাপমাত্রা কমলে অভ্যন্তরীণ রোধ বাড়ে। তবে, এটি ব্যাটারির ধরনের উপরও নির্ভর করে।
প্রশ্ন: লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির অভ্যন্তরীণ রোধ কত?
উত্তর: লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির অভ্যন্তরীণ রোধ সাধারণত খুবই কম থাকে, প্রায় কয়েক মিলিওহম (mΩ)।
প্রশ্ন: অভ্যন্তরীণ রোধ কি পরিবর্তনশীল?
উত্তর: হ্যাঁ, অভ্যন্তরীণ রোধ পরিবর্তনশীল। এটি ব্যাটারির বয়স, তাপমাত্রা এবং ব্যবহারের ধরনের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।
অভ্যন্তরীণ রোধ এবং ইম্পিডেন্স (Impedance) এর মধ্যে পার্থক্য কী?
যদিও অভ্যন্তরীণ রোধ এবং ইম্পিডেন্স একই রকম মনে হতে পারে, এদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অভ্যন্তরীণ রোধ হলো ডিসি (DC) কারেন্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেখানে ইম্পিডেন্স এসি (AC) কারেন্টের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ইম্পিডেন্সের মধ্যে রোধের পাশাপাশি ক্যাপাসিট্যান্স এবং ইন্ডাকট্যান্সের প্রভাবও অন্তর্ভুক্ত থাকে।
বিষয়টি আরও একটু বুঝিয়ে বলা যাক। ধরুন, আপনি একটা পুকুরে ঢিল ছুঁড়লেন। ঢিলটা যখন স্থির জলে পড়বে, তখন যে বাধাটা তৈরি হবে, সেটা অনেকটা রোধের মতো। কিন্তু যদি পুকুরে ঢেউ থাকে, তাহলে ঢিলটা ফেলার পর ঢেউয়ের কারণে আরও বেশি জটিল একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে, যেখানে ঢিলের গতিপথ এবং শক্তি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যাবে। ইম্পিডেন্স অনেকটা তেমনই – এখানে কারেন্টের সঙ্গে ক্যাপাসিট্যান্স ও ইন্ডাকট্যান্সের মতো বিষয়গুলোও যুক্ত থাকে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
নিচের টেবিলের মাধ্যমে বিষয়টি আরও পরিষ্কার করা হলো:
বৈশিষ্ট্য | অভ্যন্তরীণ রোধ (Internal Resistance) | ইম্পিডেন্স (Impedance) |
---|---|---|
কারেন্ট | ডিসি (DC) | এসি (AC) |
উপাদান | শুধুমাত্র রোধ | রোধ, ক্যাপাসিট্যান্স, ইন্ডাকট্যান্স |
পরিমাপ | ওহম (Ω) | ওহম (Ω) |
প্রভাব | ভোল্টেজ ড্রপ, কারেন্ট হ্রাস | ফেজ শিফট, ফ্রিকোয়েন্সি নির্ভরতা |
উপসংহার
অভ্যন্তরীণ রোধ ব্যাটারি এবং অন্যান্য তড়িৎ উৎসের কর্মক্ষমতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এটি ভোল্টেজ ড্রপ, কারেন্ট সরবরাহ হ্রাস এবং ব্যাটারির আয়ু কমিয়ে দিতে পারে। তাই, অভ্যন্তরীণ রোধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা এবং এটি নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।
আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে অভ্যন্তরীণ রোধ সম্পর্কে আপনার ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। যদি আপনার আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর হ্যাঁ, আপনার বন্ধুদের সাথে এই তথ্য শেয়ার করতে ভুলবেন না!