আচ্ছা, ছোটবেলার বাংলা ব্যাকরণের ক্লাসের কথা মনে আছে? সেই “অ, আ, ই, ঈ” দিয়ে শুরু? ভাবছেন, এত বছর পর আবার স্বরবর্ণ (vowel) নিয়ে কেন মাথা ঘামাবো? কিন্তু বস, এই স্বরবর্ণগুলোই কিন্তু ভাষার প্রাণ! এদের ছাড়া শব্দ তৈরিই হতো না। তাই, চলুন, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা স্বরবর্ণের অন্দরমহলে ডুব দেই, খুঁটিনাটি সবকিছু জেনে আসি। আপনি যদি বাংলা ভাষার ছাত্র হন বা ভাষার প্রতি আগ্রহ রাখেন, তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য।
স্বরবর্ণ: শব্দের প্রাণভোমরা
স্বরবর্ণ (vowel) বাংলা বর্ণমালার সেই সদস্য, যারা অন্য কোনো বর্ণের সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে উচ্চারিত হতে পারে। এরা একাই নিজেদের সুর তৈরি করতে পারে, কারো উপর নির্ভরশীল নয়। “মা” শব্দটি ধরুন। এখানে “আ” একটি স্বরবর্ণ এবং এটি নিজে নিজেই উচ্চারিত হচ্ছে।
স্বরবর্ণের সংজ্ঞা
ব্যাকরণ অনুযায়ী, যে বর্ণ অন্য কোনো বর্ণের সাহায্য ছাড়া নিজে উচ্চারিত হতে পারে, তাকে স্বরবর্ণ বলে। বাংলা বর্ণমালায় মোট ১১টি স্বরবর্ণ রয়েছে।
১১টি স্বরবর্ণ কী কী?
বাংলা বর্ণমালার স্বরবর্ণগুলো হলো:
- অ
- আ
- ই
- ঈ
- উ
- ঊ
- ঋ
- এ
- ঐ
- ও
- ঔ
স্বরবর্ণের প্রকারভেদ
এই ১১টি স্বরবর্ণকে উচ্চারণ এবং গঠনগত দিক থেকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। চলুন, সেই ভাগগুলো দেখে নেওয়া যাক:
উচ্চারণভেদে স্বরবর্ণের প্রকার
উচ্চারণের সময়কালের উপর ভিত্তি করে স্বরবর্ণকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়:
হ্রস্ব স্বর
যে স্বরবর্ণগুলো উচ্চারণ করতে কম সময় লাগে, তাদের হ্রস্ব স্বর বলে। যেমন: অ, ই, উ, ঋ। এদেরকে ছোট স্বরও বলা হয়।
দীর্ঘ স্বর
যে স্বরবর্ণগুলো উচ্চারণ করতে বেশি সময় লাগে, তাদের দীর্ঘ স্বর বলে। যেমন: আ, ঈ, ঊ, এ, ঐ, ও, ঔ। এদেরকে বড় স্বরও বলা হয়।
গঠনভেদে স্বরবর্ণের প্রকার
গঠন অনুযায়ী স্বরবর্ণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
মৌলিক স্বর
যে স্বরবর্ণগুলো অন্য কোনো স্বরের সাহায্য ছাড়া গঠিত হয়, তাদের মৌলিক স্বর বলে। বাংলা ভাষায় মৌলিক স্বরবর্ণ সাতটি: অ, আ, ই, উ, এ, ও, অ্যা।
যৌগিক স্বর বা দ্বিস্বর
যে স্বরবর্ণগুলো দুইটি স্বরবর্ণের যোগে গঠিত হয়, তাদের যৌগিক স্বর বা দ্বিস্বর বলা হয়। বাংলা ভাষায় যৌগিক স্বরবর্ণ দুইটি: ঐ (ও + ই) এবং ঔ (ও + উ)।
স্বরবর্ণের ব্যবহার: কোথায় কীভাবে?
স্বরবর্ণগুলো শব্দের শুরুতে, মধ্যে এবং শেষে ব্যবহৃত হতে পারে। এদের ব্যবহার শব্দকে অর্থবহ করে তোলে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
- শব্দের শুরুতে: অজগর (অ), আকাশ (আ), ইঁদুর (ই), ঈগল (ঈ), উকিল (উ), ঊষা (ঊ), ঋণ (ঋ), একতা (এ), ঐক্য (ঐ), ওজন (ও), ঔষধ (ঔ)
- শব্দের মাঝে: কথা (অ), বাবা (আ), চিনি (ই), কী (ঈ), ফুল (উ), পূজা (ঊ), কৃষক (ঋ), খেলা (এ), দৈব (ঐ), বোন (ও), বউ (ঔ)
- শব্দের শেষে: মা (আ), দিদি (ই), বৌদি (ঈ), আলু (উ), বঁধু (ঊ), গেঁয়ো (ও), নৌ (ঔ)
“অ” এর ব্যবহারবিধি: এক মজার খেলা
“অ” এমন একটি স্বরবর্ণ, যা শব্দের বানানে থাকলেও অনেক সময় উচ্চারিত হয় না। আবার কিছু ক্ষেত্রে এর উচ্চারণ একটু ভিন্ন হয়। চলুন, কয়েকটা উদাহরণ দেখি:
- অ-এর অনুচ্চারণ: অনেক সময় শব্দের প্রথমে “অ” থাকলেও তার উচ্চারণ হয় না। যেমন: “অমর” শব্দটিতে “অ” এর উচ্চারণ নেই।
- সংবৃত উচ্চারণ: কিছু ক্ষেত্রে “অ” অনেকটা “ও”-এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন: “অতুল” শব্দটা “ওতুল”-এর মতো শোনাতে পারে।
স্বরবর্ণ ও বাংলা ব্যাকরণ: কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
স্বরবর্ণ শুধু বর্ণমালার অংশ নয়, এরা বাংলা ব্যাকরণেরও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সন্ধি, কারক, সমাস – ব্যাকরণের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বরবর্ণের ভূমিকা রয়েছে।
সন্ধি
দুটি বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলে। স্বরবর্ণের সাথে স্বরবর্ণের মিলন হলে তাকে স্বরসন্ধি বলে। যেমন: বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয় (আ + আ = আ)।
কারক ও বিভক্তি
কারক ও বিভক্তি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে স্বরান্ত শব্দগুলোর ভূমিকা আছে। স্বরান্ত শব্দ বলতে বোঝায়, যে শব্দের শেষে স্বরবর্ণ থাকে।
সমাস
সমাসের ক্ষেত্রেও স্বরবর্ণ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: “রাজা ও রাণী” मिलकर হয় “রাজরাণী”।
স্বরবর্ণ মনে রাখার সহজ উপায়
স্বরবর্ণগুলো মনে রাখাটা অনেকের কাছে কঠিন মনে হতে পারে। তবে কিছু সহজ কৌশল অবলম্বন করলে এটা সহজ হয়ে যায়:
- ছড়া তৈরি করুন: স্বরবর্ণ দিয়ে মজার ছড়া তৈরি করে পড়ুন। যেমন: “অ তে অজগর আসছে তেড়ে, আ তে আমটি আমি খাব পেড়ে।”
- ছবি ব্যবহার করুন: প্রতিটি স্বরবর্ণের সাথে সম্পর্কিত ছবি ব্যবহার করে শিখুন। যেমন: “ই তে ইঁদুর” – এর সাথে ইঁদুরের ছবি।
- নিয়মিত অনুশীলন: প্রতিদিন স্বরবর্ণগুলো লিখুন এবং পড়ুন। এতে আপনার স্মৃতিতে গেঁথে যাবে।
স্বরবর্ণ নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- বাংলা ভাষায় “অ” সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
- “ঋ” একটি মাত্র স্বরবর্ণ, যা অন্য কোনো বর্ণের সাথে যুক্ত হয়ে যুক্তবর্ণ তৈরি করে না।
- “এ” এবং “ও” – এই দুইটি স্বরবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপ নেই।
স্বরবর্ণ: কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এখানে স্বরবর্ণ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
প্রশ্ন ১: স্বরবর্ণ কাকে বলে?
উত্তর: যে বর্ণ অন্য কোনো বর্ণের সাহায্য ছাড়া নিজে উচ্চারিত হতে পারে, তাকে স্বরবর্ণ বলে।
প্রশ্ন ২: বাংলা বর্ণমালায় কয়টি স্বরবর্ণ আছে?
উত্তর: বাংলা বর্ণমালায় মোট ১১টি স্বরবর্ণ আছে।
প্রশ্ন ৩: স্বরবর্ণের প্রকারভেদগুলো কী কী?
উত্তর: উচ্চারণভেদে স্বরবর্ণ দুই প্রকার: হ্রস্ব স্বর ও দীর্ঘ স্বর। গঠনভেদে স্বরবর্ণ দুই প্রকার: মৌলিক স্বর ও যৌগিক স্বর।
প্রশ্ন ৪: যৌগিক স্বরবর্ণ কয়টি ও কী কী?
উত্তর: যৌগিক স্বরবর্ণ দুইটি: ঐ (ও + ই) এবং ঔ (ও + উ)। যৌগিক স্বরকে দ্বিস্বরও বলা হয়। কারণ এটা দুইটি স্বরবর্ণের মিলিত রুপ।
প্রশ্ন ৫: “অ” এর উচ্চারণ কখন “ও”-এর মতো হয়?
উত্তর: কিছু শব্দের ক্ষেত্রে “অ” অনেকটা “ও”-এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন: “অতুল” শব্দটি “ওতুল”-এর মতো শোনাতে পারে। একে “সংবৃত উচ্চারণ” বলা হয়।
আপনার জন্য কিছু টিপস
- নিজের নাম দিয়ে স্বরবর্ণ খুঁজে বের করুন। দেখুন তো, আপনার নামের মধ্যে কয়টি স্বরবর্ণ আছে!
- স্বরবর্ণ দিয়ে নতুন শব্দ তৈরি করার চেষ্টা করুন। বন্ধুদের সাথে এই নিয়ে খেলা করতে পারেন।
- বাংলা কবিতা পড়ুন এবং সেখানে স্বরবর্ণগুলো খুঁজে বের করুন।
উপসংহার
স্বরবર્ণ বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এদের সঠিক ব্যবহার এবং জ্ঞান আমাদের ভাষাকে আরও সুন্দর ও সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করে। আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি আপনাদের স্বরবর্ণ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে পেরেছে। যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করুন। আর হ্যাঁ, বাংলা ভাষাকে ভালোবাসুন, চর্চা করুন। কারণ, ভাষা আমাদের পরিচয়।