আসসালামু আলাইকুম! কেমন আছেন সবাই? কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আমরা প্রতিদিন কত শব্দ ব্যবহার করি, আর এই শব্দগুলো আসলে কী? আচ্ছা, “শব্দ কাকে বলে” – এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই অনেকের মনে উঁকি দেয়, বিশেষ করে যখন বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়। চিন্তা নেই, আজ আমরা এই বিষয়টি নিয়ে মজার আলোচনা করব, একদম সহজ ভাষায়! যেন সবাই বুঝতে পারে।
শব্দ কী? শব্দের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ
শব্দ হলো এক বা একাধিক ধ্বনি মিলে তৈরি হওয়া অর্থপূর্ণ একটি একক। এই যেমন, “মা”, “বাবা”, “ভাত”, “যাই” – এগুলো সবই এক একটি শব্দ। প্রতিটি শব্দেরই একটা মানে আছে, যা মনের ভাব প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
শব্দের সংজ্ঞা
ব্যাকরণের ভাষায় শব্দ হলো সেই জিনিস, যা এক বা একাধিক ধ্বনি দিয়ে গঠিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে। ধ্বনিগুলো যখন একটি নির্দিষ্ট নিয়মে সাজানো হয় এবং একটি অর্থ তৈরি করে, তখনই সেটা শব্দ হয়ে ওঠে।
শব্দের প্রকারভেদ
বাংলা ব্যাকরণে শব্দকে প্রধানত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। আসুন, সেগুলো একটু দেখে নেই:
- বিশেষ্য (Noun): কোনো ব্যক্তি, বস্তু, স্থান, বা গুণের নাম বোঝায়। যেমন: মানুষ, টেবিল, ঢাকা, সততা।
- সর্বনাম (Pronoun): বিশেষ্যের পরিবর্তে যে শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন: আমি, তুমি, সে, তারা।
- বিশেষণ (Adjective): যে শব্দ বিশেষ্য বা সর্বনামের গুণ, দোষ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করে। যেমন: ভালো, খারাপ, সুন্দর, দশ।
- ক্রিয়া (Verb): কোনো কাজ করা বা হওয়া বোঝায়। যেমন: যায়, খায়, ঘুমায়, হবে।
- অব্যয় (Indeclinable): যে শব্দের কোনো পরিবর্তন হয় না এবং যা দুটি শব্দ বা বাক্যকে যুক্ত করে। যেমন: এবং, কিন্তু, অথবা, তাই।
উৎপত্তি অনুসারে শব্দের শ্রেণিবিভাগ
শব্দের উৎপত্তি ও উৎস অনুসারে বাংলা ভাষায় শব্দগুলোকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগগুলো আমাদের ভাষার ইতিহাস এবং অন্যান্য ভাষার সঙ্গে এর সম্পর্ক জানতে সাহায্য করে। নিচে এই শ্রেণিবিভাগ নিয়ে আলোচনা করা হলো:
-
তৎসম শব্দ: যে শব্দগুলো সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে কোনো পরিবর্তন ছাড়াই বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলোকে তৎসম শব্দ বলে। তৎসম শব্দের অর্থ হলো “তার সমান”, অর্থাৎ সংস্কৃতের সমান।
- উদাহরণ: সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, ভবন, মানব, পিতা, মাতা, ইত্যাদি।
-
অর্ধ-তৎসম শব্দ: যে শব্দগুলো সংস্কৃত ভাষা থেকে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়, সেগুলোকে অর্ধ-তৎসম শব্দ বলে। এগুলো তৎসম শব্দের মতো সরাসরি আসেনি, কিছুটা বিকৃত হয়ে এসেছে।
- উদাহরণ: জ্যোৎস্না > জ্যোছনা, শ্রাদ্ধ > ছেরাদ্দ, গৃহিণী > গিন্নী, ইত্যাদি।
-
তদ্ভব শব্দ: যে শব্দগুলো সংস্কৃত ভাষা থেকে পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাকৃত ভাষার স্তর পেরিয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলোকে তদ্ভব শব্দ বলে। তদ্ভব শব্দের অর্থ হলো “তা থেকে উৎপন্ন”।
* উদাহরণ: হস্ত > হ> হাত, কর্ম > কন্ম > কাম, মৎস্য > ম> মাছ, ইত্যাদি।
-
দেশি শব্দ: বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীদের ভাষা এবং সংস্কৃতি থেকে যে শব্দগুলো বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলোকে দেশি শব্দ বলে। এই শব্দগুলোর মূল উৎস সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।
- উদাহরণ: কুঁড়ি, পেট, চুলা, ডাব, ডিঙ্গা, ঢেঁকি, ইত্যাদি।
-
বিদেশি শব্দ: বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদেশি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের ফলে তাদের ভাষা থেকে যে শব্দগুলো বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে, সেগুলোকে বিদেশি শব্দ বলে।
- ইংরেজি: চেয়ার, টেবিল, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, হসপিটাল, ডাক্তার, নার্স, ইত্যাদি।
- আরবি: আল্লাহ, ইসলাম, ঈমান, কুরআন, হাদিস, ঈদ, রোজা, নামাজ, হজ, যাকাত, ইত্যাদি।
- ফারসি: খোদা, গুনাহ, দোজখ, বেহেশত, রোজা, নামাজ, বাদশা, বেগম, মেথর, তোশক, ইত্যাদি।
- পর্তুগিজ: আলমারি, আনারস, আলপিন, আলকাতরা, গির্জা, গোডাউন, চাবি, পাউরুটি, বালতি, ইত্যাদি।
- ওলন্দাজ: ইস্কাপন, টেক্কা, তুরুপ, রুইতন, হরতন, ইত্যাদি।
- ফরাসি: কার্তুজ, কুপন, রেস্তোরাঁ, বুর্জোয়া, ইত্যাদি।
- চীনা: চা, চিনি, লিচু, ইত্যাদি।
- জাপানি: রিকশা, হারিকিরি, জুডো, ইত্যাদি।
- বর্মি: লুঙ্গি, ফুঙ্গি, ইত্যাদি।
গঠন অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ
গঠন অনুসারে শব্দ দুই প্রকার:
-
মৌলিক শব্দ: যে শব্দকে ভাঙলে আর কোনো অর্থপূর্ণ অংশ পাওয়া যায় না, তাকে মৌলিক শব্দ বলে। এগুলো হলো ভাষার ভিত্তি।
- উদাহরণ: মা, বাবা, বই, কলম, গাছ, নদী, ইত্যাদি।
-
সাধিত শব্দ: যে শব্দকে ভাঙলে এক বা একাধিক অর্থপূর্ণ অংশ পাওয়া যায়, তাকে সাধিত শব্দ বলে। এগুলো মৌলিক শব্দ থেকে তৈরি হয়।
- উদাহরণ: চলন্ত (চল + অন্ত), জানালা (জান + আলা), গরমিল (বে + গরমিল), শিক্ষক (শিক্ষ + অক), ইত্যাদি।
সাধিত শব্দ কিভাবে গঠিত হয়?
সাধিত শব্দ সাধারণত দুই বা ততোধিক উপায়ে গঠিত হতে পারে:
- প্রত্যয় যোগে: মৌলিক শব্দের সাথে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠিত হয়। যেমন: চল + অন্ত = চলন্ত।
- উপসর্গ যোগে: মৌলিক শব্দের আগে উপসর্গ যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠিত হয়। যেমন: প্র + হার = প্রহার।
- সমাসবদ্ধ হয়ে: দুই বা ততোধিক শব্দ মিলিত হয়ে নতুন শব্দ গঠিত হয়। যেমন: বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয়।
অর্থ অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ
অর্থের দিক থেকে শব্দকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
-
যৌগিক শব্দ: যে শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থ একই, তাকে যৌগিক শব্দ বলে। অর্থাৎ, শব্দটিকে ভাঙলে যে অর্থ পাওয়া যায়, বাস্তবেও তার একই অর্থ থাকে।
- উদাহরণ:
- গায়ক = গৈ + অক (যে গান করে)।
- কর্তব্য = কৃ + তব্য (যা করা উচিত)।
- বাবুয়ানা = বাবু + আনা (বাবুর ভাব)।
- দুগ্ধপোষ্য = দুগ্ধ + পোষ্য (দুধ দ্বারা প্রতিপালিত)।
- উদাহরণ:
-
রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ: যে শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থ আলাদা, তাকে রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ বলে। এক্ষেত্রে, শব্দটি তার মূল অর্থ থেকে সরে গিয়ে অন্য একটি বিশিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়।
- উদাহরণ:
- বাঁশি = বাঁশ দিয়ে তৈরী (কিন্তু এখন যেকোনো বাঁদ্যযন্ত্র)।
- তৈল = তিল থেকে উৎপন্ন (কিন্তু এখন যেকোনো তেল)।
- সন্দেশ = সংবাদ (কিন্তু এখন মিষ্টি)।
- গবেষণা = গো + এষণা (গরু খোঁজা), কিন্তু এর সাধারণ অর্থ ব্যাপক অধ্যয়ন।
- উদাহরণ:
-
যোগরূঢ় শব্দ: যে শব্দ দুই বা ততোধিক পদের মিলনে তৈরি হয় এবং সেই পদগুলোর অর্থের চেয়ে ভিন্ন একটি বিশিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে, তাকে যোগরূঢ় শব্দ বলে।
* উদাহরণ:
* পঙ্কজ = পঙ্কে জন্মে যা (পদ্মফুল)। এখানে 'পঙ্ক' মানে পাঁক বা কাদা এবং 'জ' মানে জন্ম নেওয়া। পঙ্কজ শব্দটি শাপলা, শালুক ইত্যাদি অন্য কোনো জলজ উদ্ভিদকে না বুঝিয়ে শুধু পদ্মফুলকেই বোঝায়।
* রাজপুত = রাজার পুত্র (কিন্তু একটি বিশেষ জাতি)।
* মহাযাত্রা = মহৎ যাত্রা (কিন্তু মৃত্যু)।
বিভিন্ন পরীক্ষায় শব্দ ও তার প্রকারভেদ
বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা এবং একাডেমিক পরীক্ষায় শব্দ ও এর প্রকারভেদ থেকে প্রশ্ন আসে। তাই এই বিষয়ে ভালো ধারণা রাখাটা খুব জরুরি। বিশেষ করে, কোন শব্দ কোন শ্রেণী থেকে এসেছে, তা মনে রাখতে হবে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
- তৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দের তালিকা তৈরি করে মুখস্থ করুন।
- বিভিন্ন শব্দের উৎস এবং ব্যবহারিক অর্থ ভালোভাবে জানুন।
- নিয়মিত ব্যাকরণের বই পড়ুন এবং উদাহরণগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখুন।
- পুরনো প্রশ্নপত্র সমাধান করুন, এতে পরীক্ষার ধরন সম্পর্কে ধারণা পাবেন।
“শব্দ কাকে বলে” নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
এই অংশে আমরা শব্দ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তার উত্তর দেখবো, যা আপনাদের মনে প্রায়ই আসে।
-
প্রশ্ন: শব্দ এবং পদের মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: শব্দ হলো একটি অর্থপূর্ণ ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টি। আর পদ হলো সেই শব্দ, যা বাক্যে ব্যবহৃত হয় এবং বিভক্তি যুক্ত হয়ে বাক্যের অংশ হিসেবে কাজ করে। -
প্রশ্ন: বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের প্রয়োজনীয়তা কী?
উত্তর: যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে বিদেশি শব্দ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, অনেক ধারণাকে সহজভাবে প্রকাশ করার জন্য বিদেশি শব্দ দরকারি। -
প্রশ্ন: মৌলিক শব্দ চেনার সহজ উপায় কী?
উত্তর: মৌলিক শব্দকে ভাঙা যায় না এবং এর কোনো উৎস নেই। এটি একটি স্বাধীন এবং অবিভাজ্য শব্দ।
- প্রশ্ন: শব্দ ভাণ্ডার বাড়ানোর উপায় কী?
উত্তর: শব্দ ভাণ্ডার বাড়ানোর জন্য বেশি করে বই পড়া, নতুন শব্দ শেখা এবং সেগুলো ব্যবহার করার চেষ্টা করা উচিত।
বাংলা শব্দকোষ: কিছু মজার তথ্য
বাংলা শব্দকোষ বিশাল এবং এতে অনেক মজার তথ্য লুকিয়ে আছে। এখানে কিছু তথ্য দেওয়া হলো:
- বাংলা ভাষায় প্রায় দুই লক্ষের বেশি শব্দ আছে।
- প্রাচীন বাংলা সাহিত্য চর্যাপদে ব্যবহৃত শব্দগুলো অনেক পুরনো এবং ঐতিহাসিক।
- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বাংলা ভাষার উৎপত্তি গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে।
শেষ কথা
আশা করি, “শব্দ কাকে বলে” এই বিষয়টি নিয়ে আপনাদের মনে আর কোনো প্রশ্ন নেই। শব্দ আমাদের ভাষা এবং ভাব প্রকাশের মূল ভিত্তি। তাই শব্দ সম্পর্কে জানাটা খুবই জরুরি। বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ, এবং এর প্রতিটি শব্দের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস।
যদি এই বিষয়ে আরও কিছু জানতে চান, তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আর হ্যাঁ, লেখাটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!
তাহলে, আজকের মতো বিদায়। ভালো থাকবেন সবাই! আল্লাহ হাফেজ!