আচ্ছা, শব্দ! ভাবছেন তো, এ আর এমন কী? ছোটবেলা থেকে তো কত শব্দ শিখলাম, বললাম। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে বেশ গভীর। শব্দ শুধু কতগুলো অক্ষরের সমষ্টি নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে থাকে ইতিহাস, সংস্কৃতি, আর আমাদের অনুভূতি। আসুন, শব্দ নিয়ে একটু অন্যরকম আলোচনা করি।
শব্দ কাকে বলে? (Shobdo Kake Bole?)
সহজ ভাষায়, এক বা একাধিক ধ্বনি মিলে যখন কোনো অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে শব্দ বলে। মানে, শুধু ‘ক’, ‘খ’ বললেই তো হবে না, ‘কলম’ বললে একটা মানে দাঁড়ায়, তাই না? এই ‘কলম’ একটা শব্দ। প্রতিটি শব্দের একটা নিজস্ব ক্ষমতা আছে, যা আমাদের মনে ছবি আঁকে, অনুভূতি জাগায়।
শব্দের সংজ্ঞা (Shobdo Sonnga)
ব্যাকরণের ভাষায় শব্দ হলো অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেন, “মনুষ্যের বাগযন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট অর্থবোধক ধ্বনিই শব্দ।” তার মানে, আমাদের মুখ দিয়ে যা বেরিয়ে আসে এবং যার একটা মানে থাকে, সেটাই শব্দ।
শব্দের প্রকারভেদ (Shobder Prokarভেদ)
শব্দকে নানাভাবে ভাগ করা যায়। অর্থের বিচারে, উৎসের বিচারে, গঠনের বিচারে – বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শব্দের প্রকারভেদ আলোচনা করা যায়। চলুন, কয়েকটি প্রধান ভাগ দেখে নিই:
উৎপত্তি বা উৎসের অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ (Utpotti বা Utser Onushare Shobder Prokarভেদ)
একটা শব্দ কোথা থেকে এসেছে, তার ওপর ভিত্তি করে শব্দকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়:
তৎসম শব্দ (Tôtsôm Shôbdô)
“তৎসম” মানে “তার সমান”। কোন শব্দ? সংস্কৃত ভাষার শব্দ। যে শব্দগুলো সরাসরি সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে এবং অবিকৃত আছে, সেগুলোই তৎসম শব্দ। যেমন: চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, মানুষ, জল, অগ্নি, পত্র, আকাশ, ভূমি।
তদ্ভব শব্দ (Tôdbhôb Shôbdô)
“তদ্ভব” মানে “তা থেকে উৎপন্ন”। এই শব্দগুলোও সংস্কৃত থেকে এসেছে, তবে একটু ঘুরে-ফিরে, রূপ বদলে। প্রথমে প্রাকৃত ভাষায় ঢুকেছে, তারপর বাংলা ভাষায় এসেছে। যেমন: হাত (হস্ত থেকে), চাঁদ (চন্দ্র থেকে), মাথা (মস্তক থেকে)।
দেশি শব্দ (Deshi Shôbdô)
আমাদের দেশের আদি ভাষা থেকে যে শব্দগুলো বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলোকে দেশি শব্দ বলে। এই শব্দগুলোর উৎস সাধারণত অজ্ঞাত। যেমন: কুঁড়েঘর, ঢেঁকি, ডিঙি, কুলা, গামছা, পেট, চোঙ্গা, টোপর।
বিদেশি শব্দ (Bideshi Shôbdô)
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদেশি জাতি আমাদের দেশে এসেছে, তাদের ভাষার কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকে গেছে। এই শব্দগুলোকে বিদেশি শব্দ বলে। যেমন:
- ইংরেজি: টেবিল, চেয়ার, পেন, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি।
- আরবি: আল্লাহ, ইসলাম, ঈমান, কুরআন, ঈদ, হজ, যাকাত, রোজা, আদালত, কানুন, কলম, কিতাব, খারিজ, গায়েব, দোয়াত।
- ফারসি: খোদা, গুনাহ, দোজখ, বেহেশত, রোজা, নামাজ, তারিখ, তোশক, দফতর, দরবার, দোকান, দস্তখত, বাদশা, বেগম, মেথর, রসদ।
- পর্তুগিজ: আনারস, আলপিন, আলমারি, ইস্ত্রি, কামিজ, চাবি, জানালা, তোয়ালে, পাদ্রি, বালতি।
- ওলন্দাজ: ইস্কাপন, টেক্কা, তুরুপ, রুইতন, হরতন।
- ফরাসি: কার্তুজ।
- তুর্কি: চাকু, তোপ, দারোগা।
- চীনা: চা, চিনি।
- বর্মি: লুঙ্গি।
মিশ্র শব্দ (Mishro Shobdo)
কখনো কখনো দেশি-বিদেশি শব্দ মিলে নতুন শব্দ তৈরি হয়। এদেরকে মিশ্র শব্দ বলে। যেমন: হেড পণ্ডিত (ইংরেজি + তৎসম), মাস্টারমশাই (ইংরেজি + বাংলা), হাটবাজার (বাংলা + ফারসি), ডাক্তারখানা (ইংরেজি + ফারসি)।
গঠন অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ (Gothon Onushare Shobder Prokarভেদ)
একটা শব্দ কিভাবে তৈরি হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে শব্দকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
মৌলিক শব্দ (Moulik Shobdo)
যে শব্দকে ভাঙা যায় না, বা বিশ্লেষণ করা যায় না, তাকে মৌলিক শব্দ বলে। এগুলো নিজে থেকেই একটা সম্পূর্ণ শব্দ। যেমন: মা, বাবা, ভাই, বোন, জল, মাটি, আকাশ, গাছ। এগুলোকে ভাঙলে কোনো অর্থ পাওয়া যায় না।
সাধিত শব্দ (Shadhito Shobdo)
যে শব্দকে বিশ্লেষণ করা যায়, বা অন্য শব্দ বা শব্দের অংশের সাথে যুক্ত করে তৈরি করা যায়, তাকে সাধিত শব্দ বলে। এই শব্দগুলো সাধারণত উপসর্গ, প্রত্যয় বা সমাস যোগে তৈরি হয়। যেমন:
- উপসর্গ যোগে: প্র + হার = প্রহার, সু + কম = সুকম
- প্রত্যয় যোগে: চল + অন্ত = চলন্ত, ডুব + উরি = ডুবুরি।
- সমাস যোগে: বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয়, সিংহাসন = সিংহ চিহ্নিত আসন।
অর্থের অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ (Arther Onushare Shobder Prokarভেদ)
শব্দের অর্থ বা মানে কেমন, তার ওপর ভিত্তি করে শব্দকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
যৌগিক শব্দ (Jougik Shobdo)
যে শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থ একই, তাকে যৌগিক শব্দ বলে। মানে, শব্দটা ভাঙলে যে অর্থ পাওয়া যায়, বাস্তবেও সেই অর্থ বোঝায়। যেমন:
- গায়ক = গৈ + ণক (যা গান করে)
- বাবুয়ানা = বাবু + আনা (বাবুর ভাব)
- কর্তব্য = কৃ + তব্য (যা করা উচিত)
রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ (Rurh বা Rurhi Shobdo)
যে শব্দ প্রত্যয় বা উপসর্গ যোগে গঠিত হয়েও তার মূল অর্থের সাথে সম্পর্ক না রেখে অন্য কোনো বিশিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে, তাকে রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ বলে। মানে শব্দটা তৈরি হওয়ার সময় একরকম অর্থ ছিল, কিন্তু এখন অন্য মানে দাঁড়িয়েছে। যেমন:
- বাঁশি = বাঁশ দিয়ে তৈরি (কিন্তু বাঁশি বললেই আমরা বাদ্যযন্ত্র বুঝি)
- তৈল = তিল থেকে উৎপন্ন (কিন্তু এখন যেকোনো তেলকেই তৈল বলা হয়)
- সন্দেশ = সংবাদ (কিন্তু আমরা মিষ্টি বুঝি)
যোগরূঢ় শব্দ (Jogorurh Shobdo)
কতগুলো শব্দ মিলে যখন একটা নতুন শব্দ তৈরি হয়, এবং সেই শব্দটি তার অংশগুলোর অর্থের সাথে সরাসরি সম্পর্ক না রেখে বিশেষ কোনো অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে যোগরূঢ় শব্দ বলে। অনেকটা রূঢ় শব্দের মতোই, তবে এটা সমাসবদ্ধ শব্দ। যেমন:
- পঙ্কজ = পঙ্কে জন্মে যা (কিন্তু পঙ্কজ মানে পদ্ম ফুল)
- রাজপুত = রাজার পুত্র (কিন্ত একটা জাতি বিশেষ)
- মহাযাত্রা = মহা + যাত্রা (কিন্তু মৃত্যু অর্থে ব্যবহৃত হয়)
শব্দ নিয়ে কিছু মজার তথ্য (Shobdo Niye Kichu Mojar Totto)
- বাংলা ভাষায় প্রায় দুই লক্ষ শব্দ আছে!
- সব ভাষার শব্দই পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে নতুন শব্দ যোগ হয়, পুরোনো শব্দ হারিয়ে যায়।
- “love” শব্দটা দিয়ে ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে বেশি গান লেখা হয়েছে!
- শব্দের ব্যবহার আমাদের ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেয়।
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখানে শব্দ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া হলো:
১. শব্দ এবং পদের মধ্যে পার্থক্য কি? (Shobdo ebong Pôder Moddhe Parthokko Ki?)
শব্দ হলো একটা সাধারণ অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি। কিন্তু যখন এই শব্দগুলো কোনো বাক্যে ব্যবহৃত হয়, তখন তা পদ হয়ে যায়। মানে, বাক্যে ব্যবহার হওয়ার পরেই শব্দের একটা ব্যাকরণগত ভূমিকা তৈরি হয়। যেমন, “বই” একটি শব্দ। কিন্তু “আমি বইটি পড়ছি” – এই বাক্যে “বইটি” হলো পদ। বই শব্দটির সাথে টি যুক্ত হয়ে এখানে কর্মপদ হিসেবে কাজ করছে।
২. বাংলা ভাষায় শব্দের উৎস কয়টি? (Bangla Bhasay Shobder Utsho Kôyti?)
বাংলা ভাষায় শব্দের প্রধান উৎস পাঁচটি: তৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ও মিশ্র শব্দ।
৩. মৌলিক শব্দ কাকে বলে উদাহরণ দাও। (Moulik Shobdo Kake Bole Udahoron Dao.)
যে শব্দকে ভাঙা যায় না, বা বিশ্লেষণ করা যায় না, তাকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন: মা, বাবা, ভাই, বোন, জল, মাটি, আকাশ, গাছ। এগুলোকে ভাঙলে কোনো অর্থ পাওয়া যায় না।
৪. তৎসম ও তদ্ভব শব্দের মধ্যে পার্থক্য কি? (Tôtshôm o Tôdbhôb Shobder Moddhe Parthokko Ki?)
তৎসম শব্দ সরাসরি সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে এবং এদের রূপের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যেমন – চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র। অন্যদিকে, তদ্ভব শব্দ সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে। তাই এদের রূপ কিছুটা পরিবর্তিত। যেমন – হাত (হস্ত থেকে), চাঁদ (চন্দ্র থেকে)।
আশা করি, শব্দ নিয়ে এই আলোচনা আপনাদের ভালো লেগেছে। শব্দ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সঠিক ব্যবহার আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করে, আমাদের চিন্তাভাবনাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। শব্দ নিয়ে আরও জানতে চান? তাহলে কমেন্টে জানান!