যিনা: একটি গভীর আলোচনা
যিনা! শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হয়, তাই না? আমাদের সমাজে এটা নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু আসল ব্যাপারটা ক’জন জানে? আজ আমরা যিনা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করব, যেন কোনো ধোঁয়াশা না থাকে।
যিনা কি? একটি সহজ ব্যাখ্যা
যিনা শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো অবৈধ যৌন সম্পর্ক। ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী, বিবাহ বন্ধন ছাড়া নারী ও পুরুষের মধ্যে যেকোনো ধরনের যৌন সম্পর্কই যিনার অন্তর্ভুক্ত। শুধু শারীরিক সম্পর্ক নয়, এর মধ্যে যৌন কামনা উদ্দীপক কথাবার্তা, স্পর্শ, এমনকি কুদৃষ্টিও শামিল। ব্যাপারটা অনেকটা এমন, যেন একটি ফুলের বাগানকে আগাছা থেকে বাঁচানো। তেমনি আমাদের চরিত্রকে নিষ্কলুষ রাখাই ইসলামের মূল লক্ষ্য।
যিনার প্রকারভেদ
যিনা শুধু এক প্রকার নয়, এর বিভিন্ন রূপ রয়েছে। প্রত্যেকটি রূপের পরিণতিও ভিন্ন।
১. শারীরিক যিনা
শারীরিক যিনা বলতে বিবাহিত অথবা অবিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ককে বোঝায়। এটা সবচেয়ে গুরুতর যিনার মধ্যে গণ্য হয়। এর শাস্তিও কঠিন।
২. চোখের যিনা
চোখের যিনা হলো খারাপ উদ্দেশ্যে কোনো নারীর দিকে তাকানো অথবা অশ্লীল কিছু দেখা। আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে, তার মধ্যে চোখকে সংযত রাখাটা খুব জরুরি।
৩. হাতের যিনা
পরনারীকে খারাপ উদ্দেশ্যে স্পর্শ করা অথবা খারাপ কিছু লেখা হাতের যিনার অন্তর্ভুক্ত। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এটা খুব সহজ হয়ে গেছে, তাই না?
৪. কানের যিনা
কানের যিনা হলো অশ্লীল গান শোনা অথবা খারাপ আলোচনা শোনা। আমাদের কান যেন ভালো কথা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকে, সেটাই কাম্য।
৫. মুখের যিনা
মুখের যিনা হলো অশ্লীল কথা বলা অথবা কাউকে খারাপ কিছু বলা। কথা বলার সময় আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে।
৬. মনের যিনা
মনে খারাপ চিন্তা আনা অথবা খারাপ কল্পনা করা মনের যিনার অন্তর্ভুক্ত। মনকে নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে কঠিন, তবে অসম্ভব নয়।
কুরআন ও হাদিসের আলোকে যিনা
কুরআন ও হাদিসে যিনার ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেক আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এই কাজ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
কুরআনের বাণী
কুরআনে বলা হয়েছে, “আর তোমরা যিনার কাছেও যেও না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট পথ।” (সূরা বনী ইসরাইল, ১৭:৩২)
হাদিসের শিক্ষা
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “চোখ যিনা করে, হাত যিনা করে, পা যিনা করে, অন্তর কামনা করে এবং লজ্জাস্থান তা সত্য অথবা মিথ্যা প্রমাণ করে।” (সহীহ মুসলিম, ২৬৫৭)
যিনার কারণ ও প্রতিকার
যিনা কেন হয়, তা জানতে পারলে এর থেকে বাঁচা সহজ। কিছু সাধারণ কারণ এবং তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা যাক।
যিনার কারণসমূহ
১. কুদৃষ্টি
খারাপ দৃষ্টি থেকেই মূলত যিনার শুরু। চোখ সংযত রাখতে পারলে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
২. অশ্লীলতা
চারপাশের অশ্লীল পরিবেশ, যেমন সিনেমা, গান অথবা সোশ্যাল মিডিয়া যিনার অন্যতম কারণ।
৩. সঙ্গদোষ
খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করলে খারাপ চিন্তা আসা স্বাভাবিক।
৪. দুর্বল ঈমান
ঈমানের দুর্বলতাই মানুষকে খারাপ কাজের দিকে ধাবিত করে।
৫. বিবাহে বিলম্ব
অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে না দেওয়া অথবা বিয়েতে দেরি করাও যিনার একটি কারণ।
যিনার প্রতিকার
১. চোখের হেফাজত
প্রথমেই নিজের দৃষ্টিকে সংযত করতে হবে। খারাপ কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিতে হবে।
২. অশ্লীলতা পরিহার
অশ্লীল সিনেমা, গান ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।
৩. সৎ সঙ্গ
ভালো বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে হবে, যারা সবসময় ভালো কাজের উপদেশ দেয়।
৪. আল্লাহর ভয়
আল্লাহর ভয় মনে রাখতে হবে। তিনি সবসময় আমাদের দেখছেন – এই অনুভূতি রাখতে হবে।
৫. নিয়মিত ইবাদত
নামাজ, রোজা ও অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে।
৬. দ্রুত বিবাহ
শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকলে দ্রুত বিয়ে করা উচিত।
যিনার শাস্তি কি?
ইসলামী শরিয়তে যিনার শাস্তি খুবই কঠোর। এর উদ্দেশ্য হলো সমাজকে কলুষিত হওয়া থেকে বাঁচানো।
ইসলামী শরীয়তের বিধান
যদি কোনো বিবাহিত ব্যক্তি যিনা করে, তাহলে তাকে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর যদি অবিবাহিত কেউ এই কাজ করে, তাহলে তাকে ১০০টি বেত্রাঘাত করা হয় এবং এক বছরের জন্য এলাকা থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
তবে বর্তমান আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে যিনার জন্য সরাসরি এই শাস্তিগুলো প্রয়োগ করা হয় না। দেশের প্রচলিত আইনে এর বিচার করা হয়।
যিনা থেকে বাঁচার উপায়
যিনা থেকে বাঁচতে হলে কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে এবং সে অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হবে। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে কিছু টিপস:
নিয়মিত দোয়া করা
আল্লাহর কাছে সবসময় সাহায্য চাইতে হবে, যেন তিনি আমাদের খারাপ কাজ থেকে বাঁচান।
আমি প্রায়ই এই দোয়াটি পড়ি “হে আল্লাহ, আমাকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা করুন।”
নিজেকে ব্যস্ত রাখা
অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তাই নিজেকে সবসময় ভালো কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। বই পড়া, খেলাধুলা করা অথবা কোনো সৃজনশীল কাজ করা যেতে পারে।
খারাপ চিন্তা পরিহার
মনের মধ্যে খারাপ চিন্তা এলে সঙ্গে সঙ্গে তা দূর করতে হবে। ভালো কিছু চিন্তা করতে হবে অথবা অন্য কোনো কাজে মন দিতে হবে।
পবিত্রতা রক্ষা
শারীরিক ও মানসিকভাবে পবিত্র থাকতে হবে। নিয়মিত গোসল করা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
ইসলামিক জ্ঞান অর্জন
ইসলাম সম্পর্কে জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হবে।
যিনা নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
যিনা নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. যিনা কি শুধু শারীরিক সম্পর্ক?
না, যিনা শুধু শারীরিক সম্পর্ক নয়। চোখের যিনা, হাতের যিনা, মুখের যিনা, কানের যিনা এবং মনের যিনাও রয়েছে।
২. অবিবাহিত অবস্থায় প্রেম করা কি যিনার অন্তর্ভুক্ত?
ইসলামে বিয়ের আগে প্রেম করাকে উৎসাহিত করা হয় না। যদি এই প্রেমের মধ্যে অশ্লীলতা অথবা খারাপ কিছু থাকে, তাহলে তা অবশ্যই যিনার মধ্যে গণ্য হবে।
৩. যিনা করলে কি ক্ষমা পাওয়া যায়?
আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল। sincere অনুশোচনা করে তওবা করলে এবং ভবিষ্যতে আর এই কাজ না করার প্রতিজ্ঞা করলে আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন।
৪. সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীল ছবি দেখা কি যিনা?
হ্যাঁ, সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীল ছবি দেখা চোখের যিনার অন্তর্ভুক্ত।
৫. যিনা থেকে বাঁচার জন্য কি করা উচিত?
যিনা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর ভয় রাখা, নিয়মিত ইবাদত করা, ভালো বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করা এবং অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা উচিত। এছাড়াও দ্রুত বিয়ে করার চেষ্টা করতে পারেন।
৬. ঘুমের মধ্যে খারাপ স্বপ্ন দেখলে কি গুনাহ হবে?
ঘুমের মধ্যে খারাপ স্বপ্ন দেখলে কোনো গুনাহ হবে না, যদি আপনি সেই বিষয়ে কোনো খারাপ চিন্তা না করেন।
৭. হস্তমৈথুন কি যিনার অন্তর্ভুক্ত?
হস্তমৈথুন একটি নিন্দনীয় কাজ এবং অনেক আলেমের মতে এটি যিনার অন্তর্ভুক্ত।
৮. পরকীয়া কি যিনার মধ্যে পরে?
অবশ্যই ! বিবাহিত অবস্থায় অন্য কারো সাথে সম্পর্ক রাখা জঘন্যতম অপরাধ গুলোর মধ্যে অন্যতম। এটা কেবল আপনার জীবন সঙ্গী নয়, আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর ও খারাপ প্রভাব ফেলে।
৯. “লিভ-ইন” সম্পর্ক কি ইসলামে বৈধ?
“লিভ-ইন” সম্পর্ক ইসলামে সম্পূর্ণ অবৈধ এবং হারাম। বিবাহ বহির্ভূত যেকোনো সম্পর্কই ইসলামে নিষিদ্ধ।
যিনার সামাজিক ও মানসিক প্রভাব
যিনা শুধু একটি ব্যক্তিগত পাপ নয়, এর সামাজিক ও মানসিক প্রভাব অনেক গভীর। এটা সমাজ এবং ব্যক্তির জীবনে অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সামাজিক প্রভাব
যিনার কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পারিবারিক সম্পর্ক ভেঙে যায়, সম্মান ও মর্যাদা নষ্ট হয় এবং সমাজে অপরাধ বেড়ে যায়।
মানসিক প্রভাব
যিনা করলে মনে অশান্তি সৃষ্টি হয়, অনুশোচনা হয় এবং আত্মবিশ্বাস কমে যায়। এছাড়া মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ এবং হতাশার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
যিনা বিষয়ক ভুল ধারণা
আমাদের সমাজে যিনা নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এই ভুল ধারণাগুলো দূর করা জরুরি।
১. যিনা শুধু শারীরিক সম্পর্ক:
অনেকেই মনে করেন যিনা শুধু শারীরিক সম্পর্ক। কিন্তু ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী, চোখের যিনা, হাতের যিনা, মুখের যিনা, কানের যিনা এবং মনের যিনাও রয়েছে।
২. শুধু অবিবাহিতদের জন্য প্রযোজ্য:
অনেকে মনে করেন যিনার বিধান শুধু অবিবাহিতদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু বিবাহিত ব্যক্তিরাও যদি এই কাজ করে, তবে তারাও সমানভাবে দায়ী।
৩. তওবা করলে ক্ষমা নেই:
অনেকে মনে করেন যিনা করার পর তওবা করলে আর ক্ষমা পাওয়া যায় না। কিন্তু আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল। sincere অনুশোচনা করে তওবা করলে এবং ভবিষ্যতে আর এই কাজ না করার প্রতিজ্ঞা করলে আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন।
শেষ কথা
যিনা একটি মারাত্মক পাপ। এটা শুধু আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নয়, সমাজকেও কলুষিত করে। তাই আসুন, আমরা সবাই এই কাজ থেকে দূরে থাকি এবং অন্যকে উৎসাহিত করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।
যদি এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমি সবসময় আপনার পাশে আছি।