আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “পল্লিউন্নয়ন“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।
পল্লিউন্নয়ন
ভূমিকা : সভ্যতার প্রথমদিকে মানুষ বন কেটে বসত গড়েছিল । ফসল ফলিয়ে অন্ন যোগাড় করে সুখে দিন কাটাচ্ছিল নিভৃত পল্লির বুকে। মানবসমাজের অগ্রগতির সাথে সাথে গড়ে উঠেছিল শহর । শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রভূমি হিসেবেই শহরের পত্তন। পরবর্তী সময়ে শহরের গুরুত্ব নানাভাবে বেড়ে যায়। দীর্ঘদিনের উত্থান-পতন ও চিন্তাচেতনার পরিবর্তনের পথ ধরেই শহর মানুষের সভ্যতার মূলভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি মানুষ চায় উন্নত জীবন যাপন করতে। উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি শহরে পাওয়া যায় বলে মানুষের ধারণা। আর এ ধারণার পথ ধরেই মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়ে পড়ছে । গ্রামে পড়ে থাকছে কেবল অশিক্ষিত এবং অপেক্ষাকৃত গরিব শ্রেণির লোকেরা।
অতীতের পল্লি : প্রায় ছিয়াশি হাজার গ্রাম নিয়ে গঠিত আজকের বাংলাদেশ। তাই আমাদের দেশের অপর নাম বলা যায় গ্রামবাংলা । ছায়াঢাকা, পাখি ডাকা চির সবুজের দেশ বাংলাদেশ। একদিন বাংলার মানুষ ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুখী এবং সৌখিন । গ্রামের মানুষের অহংকার ছিল গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু আর ক্ষেতভরা নানা ফসল। গ্রামের লোকেরা ছিল আত্মনির্ভরশীল । যা তাদের প্রয়োজন ছিল তা নিজেরাই তৈরি করত । গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল স্বনির্ভর। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তারা গল্প- গুজব ও খেলাধুলা করে দিন কাটাত। প্রতিটি মানুষের মুখে ছিল পরিতৃপ্তির হাসি। গ্রামের ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় ছিল নবান্নের উৎসব। বসত জারি, সারি, পালাগান ও পুঁথিপাঠের আসর । প্রতিটি গ্রামই ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এবং সম্পদে ভরপুর ।
আধুনিক পল্লি : শিল্পী যার ছবি আঁকতেন, যাকে নিয়ে কবিতা লিখতেন কবি, গায়ক যার গাইতেন গান, সেই অপরূপ রূপসী বাংলার রূপ আর সেরকম নেই। বাংলার গ্রাম আজ হতশ্রী হয়ে গেছে। বিগত দিনের সেই সমাজনীতি, ধর্মনীতি ও অর্থনীতি আজ কোথায় বিলীন হয়ে গেছে। এসবের পরিবর্তে গ্রামে আজকাল দেখা যায় দলাদলি, মারামারি, কোন্দল ও ঝগড়া-ফ্যাসাদ। গ্রামে গ্রামে আজ জানমালের নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছে। বর্তমান চাকচিক্যময় জগতে শহরের লোকদের মতো গ্রামের লোকেরাও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লোভনীয় বিলাসদ্রব্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আত্মনির্ভরশীল গ্রামবাসীরা আজ শহরমুখী হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাম ত্যাগ করে শহরে আশ্রয় নিচ্ছে। গ্রামের লোকেরা আজো অশিক্ষায় ডুবে আছে। রোগ ব্যাধিতে ভুগছে, বিবস্ত্র হয়ে বাঁচছে, নিরন্ন হয়ে ধুকে ধুকে মরছে। অতীতের অবস্থা আজ আর গ্রামে নেই। অভাবের এক জ্বালাময়ী জিহ্বা বিস্তার করে আছে। তাই গ্রামের লোকেরা দলে দলে চলে যাচ্ছে শহরে। কিন্তু শহরে এত লোকের সংস্থানের জায়গা কোথায়? তাই দেখা যায়, তাপদগ্ধ দিবসে কিংবা নিদারুণ শীতে অনাবৃত দেহে খোলা আকাশের তলে, মশার দংশন সহ্য করে ফুটপাথে দিনাতিপাত করছে অসংখ্য মানুষ। জঠরজ্বালা সহ্য করতে না পেরে নারীরা সতীত্ব বিসর্জন দিচ্ছে আর গ্রামে পড়ে থাকছে অশিক্ষিত দরিদ্র লোকেরা । এই হলো আধুনিক গ্রামের অবস্থা।
পল্লি উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা : গ্রামগুলো যেন আজ তার অতীতের ঐতিহ্য হারিয়ে স্বনির্ভর থেকে পরমুখাপেক্ষী হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ যেন আজ কি হারিয়ে ফেলেছে যার দরুন তারা হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষে ৮৬ হাজার গ্রামে উন্নয়ন বিধান করা দরকার। কারণ গ্রামের উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বলেছেন, গ্রামকে অবহেলা করে কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না।’ তাই তাদের উপদেশ—‘গ্রামে ফিরে যাও’। দেশের জনগণকে অভাব-রাহুর কবল থেকে মুক্ত করার জন্য এবং একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য পল্লি উন্নয়ন অপরিহার্য। শহরগুলো আজ জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে গর্ধভের মতো হাঁপাচ্ছে। তাই দেশের অন্ন সমস্যা দূর, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য বজায় রাখতে হলে পল্লিকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে হবে। পল্লিতে বিরাজমান সমস্যাগুলো নির্মূল করতে পারলেই তা সম্ভব হতে পারে। গ্রামের উন্নয়নের মধ্যেই দেশের উন্নয়ন নিহিত।
গ্রাম বা পল্লি উন্নয়নের দিক : গ্রামকে বুঝতে হলে গ্রামকে স্টাডি করতে হবে, গ্রামের উন্নয়ন কাজে হাত দেওয়ার আগে সেখানকার সমস্যাদি ও বর্তমান অবস্থা অনুধাবন করতে হবে। বিশেষ করে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ইত্যাদি বিষয়ের উন্নতি বিধানের মধ্যে দিয়ে পল্লির উন্নয়ন করা যায় । নিচে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হলো-
কৃষি : বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। পল্লির শতকরা নব্বই জন লোকই কৃষক এবং কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই কৃষির উন্নয়ন ছাড়া পল্লিজীবনের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসতে পারে না। গ্রামের মানুষের যদি অন্নের অভাব থাকে, তাহলে সারা দেশেই অন্নের অভাব লেগে থাকবে। কাজেই পল্লির কৃষকেরা যাতে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে এবং উচ্চ ফলনশীল বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদি স্বল্পমূল্যে ও সময়মত পায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ফসল রক্ষা করতে পারে, সে ব্যবস্থা গড়ে তোলতে হবে ।
কুটির শিল্পের উন্নয়ন : দেশের বিপুল জনসংখ্যা কেবল কৃষির ওপর নির্ভর করেই সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে না। দেশে বিপুলসংখ্যক লোক আজ বেকার ও অর্ধ বেকার এবং অনেকের আয়ের পথ অত্যন্ত সীমিত। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পল্লিবাসীর আর্থিক উন্নয়নের জন্য কুটির শিল্পের উন্নতি সাধন করা প্রয়োজন। পল্লির বুক থেকে বেকারত্ব অবসান করার জন্য নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান তুলতে হবে। কুটির শিল্পের উন্নতির মাধ্যমে পল্লির অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়তে হবে। পিতল, তামা, কাঁসা ইত্যাদি যা পরি অঞ্চলে তৈরি হতো, এসব শিল্পে পুনর্জীবন ফিরিয়ে আনতে হবে। পল্লিবাসীরা যাতে তাদের উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর ন্যায্যমূল্য পায় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদির সাহায্যে বহির্বিশ্বের সাথে পল্লির যোগসূত্র গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষার প্রসার : শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। বর্তমান যুগে শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাই পল্লির উন্নয়ন সাধন করতে হলে গ্রামে গ্রামে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। পল্লির নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে অদৃষ্টবাদিতা ও নানা রকম কুসংস্কারের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। পল্লির প্রতিটি শিশু যাতে শিক্ষা অর্জন করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। তাহলেই গ্রাম তথা পল্লির উন্নয়ন সম্ভব।
স্বাস্থ্য উন্নয়ন : স্বাস্থ্য মানুষের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু আমাদের পল্লিতে স্বাস্থ্য সংরক্ষণের সুযোগ একেবারেই অনুপস্থিত। নানারকম রোগব্যাধির কবলে পড়ে পল্লিবাসীরা অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। তাই আজ পল্লিতে দরকার উপযুক্ত শিক্ষা, পরিচ্ছন্ন বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানি এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষাব্যবস্থা। পল্লিবাসীরা দেশের প্রাণ, তারা ভগ্নস্বাস্থ্য, দুর্বল ও অক্ষম হলে দেশ খুবই সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। গ্রামের মানুষ যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করে, তাতে পরিবেশ নষ্ট হয় এবং স্বাস্থ্যের জন্য তা ক্ষতিকর। তাই সেনিটারী পায়খানার ব্যবস্থা করে এ অবস্থা দূর করতে হবে। এভাবে গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব।
উপসংহার : গ্রামের লোকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা একান্ত প্রয়োজন এবং এ ব্যাপারে ঘরবাড়ির মান উন্নয়ন, সেনিটেশনের সুব্যবস্থা, রাস্তাঘাট মেরামত ও তৈরি, জানমালের নিরাপত্তা বিধান ও গ্রামগুলোকে বৈদ্যুতিকীকরণের ব্যবস্থা করা দরকার। গ্রামে গ্রামে আবার প্রাণ সঞ্চার করার লক্ষ্যে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে আমোদ-প্রমোদ এবং অবসর বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। জাতিকে বড় করতে হলে পল্লির মানুষকে প্রথমে জাগাতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এর জন্য গ্রামে গ্রামে পাঠাগার গড়ে তোলা দরকার। পল্লির উন্নতির জন্য সরকার এবং শহরবাসীকেও এগিয়ে আসতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া বড় কাজে সাফল্য লাভ করা যায় না। মোটকথা, গ্রাম তথা পল্লির উন্নয়নের ভেতর দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব ।
সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করছি আমাদের এই পোস্ট থেকে রচনা যেটি তুমি চাচ্ছিলে সেটি পেয়ে গিয়েছ। যদি তুমি আমাদেরকে কোন কিছু জানতে চাও বা এই রচনা নিয়ে যদি তোমার কোনো মতামত থাকে, তাহলে সেটি আমাদের কমেন্টে জানাতে পারো। আজকের পোস্টে এই পর্যন্তই, তুমি আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করে আমাদের বাকি পোস্ট গুলো দেখতে পারো।