আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “আন্তর্জাতিক নারী দিবস“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস
ভূমিকা : পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই হলো নারী । কিন্তু নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত । অনেক সমাজে নারীকে চার দেয়ালে বন্দীজীবন যাপন করতে হয়। কিন্তু মানুষ হিসেবে নারীরও রয়েছে পুরুষের সমান অধিকার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রভাবে নারীরা একদিকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে শিক্ষা-দীক্ষা, কর্মসংস্থান, চাকরির বেতনভাতা, কাজের পরিবেশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে আছে। শুধু তাই নয়, নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা না দেওয়ায় নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই নারীরা তাদের প্রতি এ অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করেছে। বিভিন্ন অন্যায়-অন্যায্য আচরণের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এরই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এটি একটি বিশেষ দিন । নারীসমাজের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এই দিবসের অঙ্গীকার।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস বা পটভূমি : নারী অধিকার সচেতনতা এবং নারীমুক্তি আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের একটি সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা কারখানার মানবেতর পরিবেশ, অসম মজুরি এবং ১২ ঘণ্টা কর্মদিবসের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এ সময় তাদের ওপর পুলিশি নির্যাতন শুরু হয় এবং অনেক নারী শ্রমিককে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নারী শ্রমিকদের এক মিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ‘নারী শ্রমিক ইউনিয়ন’ গঠিত হয়। ১৯০৮ সালে নারী শ্রমিকরা নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে এবং ১৯১০ সালে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে জার্মান নারী নেতা ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব করেন। ১৯১৪ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ জাতিসংঘ এ দিনটিকে স্বীকৃতি দেয়।
নারী দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : নারীদের কাজের স্বীকৃতি, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিতকরণ, সারাবিশ্বে নারী নির্যাতন এবং নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় নারীর ভূমিকা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় নারীর ভূমিকা, অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর ভূমিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রজনন প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীর প্রতিবন্ধকতা দূর করাসহ সকল ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ নারী দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
আধুনিক বিশ্বে নারীর অবস্থান : ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নারীসমাজের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু এ অগ্রগতি পুরুষের অগ্রগতির সমকক্ষ নয়। এ অগ্রগতির চিত্র উন্নয়নশীল দেশে আরও শোচনীয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় ৬০ কোটি নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। উন্নত দেশগুলোতেও এ সংখ্যা একেবারে কম নয়। ইতালি, ফ্রান্স, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশেও শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশের কথা বিবেচনা না করে যদি সমগ্র বিশ্বের কথা জনসংখ্যার প্রায় ৭০ ভাগই নারী । কেবল অশিক্ষা ও দরিদ্রতাই নারীদের অবস্থান বিবেচনার মাপকাঠি নয়, নারী নির্যাতন এবং নারীর , বিশ্বের অশিক্ষিত জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই নারী এবং বিশ্বে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী প্রতি সহিংসতার বিষয়টিও উন্নত বিশ্বে নারীর প্রকৃত অবস্থানকে পরিস্ফুট করে ।
বাংলাদেশে নারীর অবস্থান : বাংলাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লেখনী ধারণ করেছিলেন। তাঁর এ অবিচ্ছেদ্য আন্দোলন ও সংগ্রাম আজ আমাদের কাছে নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রেরণা । যদিও সেই সময় থেকে বর্তমান সময়ের ব্যবধানে নারীর অবস্থার অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তারা শিক্ষাগ্রহণ করছে, চাকরি করছে ঠিকই কিন্তু তাদের ইচ্ছা, চলাফেরা সবকিছুই পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমাদের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে কুসংস্কার, গোঁড়ামি, ধর্মীয় বিধিনিষেধ অত্যন্ত প্রবল। প্রতিদিনই আমাদের দেশে অনেক নারী অ্যাসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ আর যৌতুকের শিকার হচ্ছে। গৃহপরিচারিকার ওপর অমানুষিক নির্যাতনের খবর পত্রিকার পাতায় হরহামেশাই দেখা যায়। তবে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করছে অসংখ্য নারী শ্রমিক। মেধা তালিকায়ও নারীরই প্রাধান্য। পিতার সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যার অসম অধিকার, পারিবারিক ও জাতীয় আইনে নারীর অসম অধিকার নারীর অমর্যাদার চিত্রই তুলে ধরে ।
বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক নারী দিবস : বাংলাদেশের মহীয়সী নারী সুফিয়া কামাল এবং আন্তর্জাতিক নারী দিবস শত বছরের বন্ধনে আবদ্ধ। তিনি ১৯৬৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণে মস্কোয় ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ ১৯৭০ সালে এ দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ৮ মার্চ পালনে নিবিষ্ট আছে। পরবর্তীকালে জাতিসংঘ ১৯৮৪ সালে সব সদস্য রাষ্ট্রকে ৮ মার্চ পালনের আহ্বান জানালে বাংলাদেশ সরকারও সেই আহ্বানে সাড়া দেয়। সেই সময় থেকে জাতিসংঘের আহ্বানে শ্রমজীবী ও স্বেচ্ছাসেবীসহ সব নারী সংগঠন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও দিবসটি পালন করছে। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন অব্যাহতভাবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার ও কার্যকর ভূমিকা রাখায় সরকার নারী নির্যাতনবিরোধী বিভিন্ন আইন প্রণয়নে বাধ্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
নারী দিবস উদ্যাপন : প্রতি বছরই বিভিন্ন স্লোগানকে সামনে রেখে সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপিত হয়। বাংলাদেশেও নারীর অধিকার কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হলো এই প্রশ্নকে সামনে রেখে নানা অনুষ্ঠান ও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। এ উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত করা হয়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীদের অংশগ্রহণে শোভাযাত্রা বের হয়। নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন আলোচনা সভারও আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন নারী সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে ।
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য : বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা নারী দিবসের প্রেক্ষিতেই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সংগ্রাম ও আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারী আন্দোলন সোচ্চার ও কার্যকর ভূমিকা পালন করায় বিভিন্ন নারী আইন প্রণীত হয়েছে। জাতিসংঘের সিডও সনদ, বেইজিং পরিকল্পনা, বেইজিং পরিকল্পনার সমর্থনে দেশের নারী উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা, জাতীয় নারীনীতি, জাতীয় নারী উন্নয়ন পরিষদ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রেক্ষাপটেই গৃহীত হয়েছে। শ্রম আইনে নারীর নিরাপত্তা বিধান, পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা রোধ, যৌতুকপ্রথা রোধ, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন রোধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারী দিবসের চেতনা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এটিই আমাদের প্রত্যাশা ।
উপসংহার : আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেবল সভা-সেমিনার প্রভৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না, এর চেতনাকে আমাদের হৃদয়ে ধারণ করতে হবে এবং নারীর অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে। আজ সারাবিশ্বের নারীসমাজের সময় এসেছে সকল প্রকার বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার। কেননা উন্নত-উন্নয়নশীল-অনুন্নত নির্বিশেষে সকল দেশেই নারীরা কমবেশি বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার। আমাদের দেশের নারীদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং নিজের অধিকার আদায়ে সক্রিয় হতে হবে। সব ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করেই আমরা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-সুফিয়া কামালের স্বপ্ন সফল করব— এই হোক সব নারীর অঙ্গীকার।
সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করছি আমাদের এই পোস্ট থেকে রচনা যেটি তুমি চাচ্ছিলে সেটি পেয়ে গিয়েছ। যদি তুমি আমাদেরকে কোন কিছু জানতে চাও বা এই রচনা নিয়ে যদি তোমার কোনো মতামত থাকে, তাহলে সেটি আমাদের কমেন্টে জানাতে পারো। আজকের পোস্টে এই পর্যন্তই, তুমি আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করে আমাদের বাকি পোস্ট গুলো দেখতে পারো।