আচ্ছা, কখনো কি এমন হয়েছে, বন্ধুদের মধ্যে সিরিয়াস একটা আলোচনার মাঝে হুট করে কেউ একজন একদম অন্যরকম একটা প্রশ্ন করে বসলো? মনে হলো, “এটা আবার কী?” ব্যস, মুহূর্তেই সিরিয়াসনেস হাওয়া! তেমনি, বিজ্ঞানের কিছু বিষয় আছে যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও, গভীরে ডুব দিলে বোঝা যায় এর গুরুত্ব অনেক। তেমনই একটা বিষয় হলো আপেক্ষিক গুরুত্ব।
আপেক্ষিক গুরুত্ব (Relative Density) জিনিসটা আসলে কী, তা নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ভয় নেই, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই আপেক্ষিক গুরুত্ব নিয়েই সহজ ভাষায় আলোচনা করব। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
আপেক্ষিক গুরুত্ব: একদম জলের মতো সোজা!
আপেক্ষিক গুরুত্ব, যাকে ইংরেজিতে Relative Density বলা হয়, হলো কোনো বস্তুর ঘনত্ব এবং ৪° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানির ঘনত্বের অনুপাত। বিষয়টা একটু জটিল লাগছে, তাই তো? চিন্তা নেই, বুঝিয়ে বলছি।
সহজ ভাষায়, আপেক্ষিক গুরুত্ব দিয়ে আমরা বুঝি একটা বস্তু পানির চেয়ে কতগুণ ভারী অথবা হালকা। এটা একটা তুলনামূলক হিসাব। ধরুন, আপনার কাছে একটা লোহার টুকরা আছে আর এক বোতল পানি। এখন যদি লোহার টুকরার আপেক্ষিক গুরুত্ব বের করতে চান, তাহলে দেখতে হবে লোহার ঘনত্ব পানির ঘনত্বের চেয়ে কত বেশি।
আপেক্ষিক গুরুত্ব কেন দরকারি?
মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, শুধু শুধু এই আপেক্ষিক গুরুত্ব বের করে কী হবে? এর কি কোনো ব্যবহার আছে? অবশ্যই আছে! আপেক্ষিক গুরুত্বের অনেক ব্যবহার রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটা নিচে উল্লেখ করা হলো:
- বস্তুর বিশুদ্ধতা নির্ণয়: কোনো বস্তু কতটা খাঁটি, তা আপেক্ষিক গুরুত্ব দিয়ে বোঝা যায়। সোনার দোকানে সোনা কেনার সময় এটি কাজে লাগে।
- খনিজ পদার্থ সনাক্তকরণ: বিভিন্ন খনিজ পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্ব আলাদা হয়। তাই, এটি ব্যবহার করে খনিজ চেনা যায়।
- জাহাজ নির্মাণ: জাহাজের ডিজাইন করার সময় আপেক্ষিক গুরুত্বের হিসাব রাখা হয়, যাতে জাহাজ নিরাপদে ভেসে থাকতে পারে।
- দৈনন্দিন জীবনে: দুধ বা অন্য কোনো তরলে ভেজাল মেশানো হয়েছে কিনা, তা আপেক্ষিক গুরুত্বের সাহায্যে সহজে বোঝা যায়।
আপেক্ষিক গুরুত্বের সংজ্ঞা (Definition of Relative Density)
আপেক্ষিক গুরুত্ব হলো একটি dimensionless রাশি। এর মানে হলো, আপেক্ষিক গুরুত্বের কোনো একক নেই। এটি কেবল একটি সংখ্যা, যা बताताয় একটি বস্তু পানির চেয়ে কতগুণ ভারী বা হালকা।
সংজ্ঞাটি এভাবেও দেওয়া যায়:
কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বস্তুর ঘনত্ব এবং ৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বিশুদ্ধ পানির ঘনত্বের অনুপাতকে আপেক্ষিক গুরুত্ব বলে।
এখানে ৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রার কথা বলার কারণ হলো, এই তাপমাত্রায় পানির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি (প্রায় ১ গ্রাম/সিসি) থাকে।
আপেক্ষিক গুরুত্বের সূত্র (Formula of Relative Density)
আপেক্ষিক গুরুত্ব বের করার একটা সহজ সূত্র আছে। সূত্রটা হলো:
আপেক্ষিক গুরুত্ব = বস্তুর ঘনত্ব / পানির ঘনত্ব
অথবা,
আপেক্ষিক গুরুত্ব = বস্তুর ওজন / সম-আয়তনের পানির ওজন
এই সূত্র ব্যবহার করে খুব সহজেই যেকোনো বস্তুর আপেক্ষিক গুরুত্ব বের করা সম্ভব।
আপেক্ষিক গুরুত্ব কিভাবে নির্ণয় করা হয়? (How to Determine Relative Density?)
আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ণয় করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে সহজ কয়েকটা পদ্ধতি নিচে আলোচনা করা হলো:
১. ঘনত্ব জেনে আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ণয়
যদি কোনো বস্তুর ঘনত্ব জানা থাকে, তাহলে খুব সহজেই আপেক্ষিক গুরুত্ব বের করা যায়। এর জন্য শুধু বস্তুর ঘনত্বকে পানির ঘনত্ব দিয়ে ভাগ করতে হবে।
যেমন:
- ধরা যাক, একটি লোহার টুকরার ঘনত্ব ৭.৮ গ্রাম/সিসি।
- আমরা জানি, পানির ঘনত্ব ১ গ্রাম/সিসি।
- তাহলে, লোহার আপেক্ষিক গুরুত্ব হবে: ৭.৮ / ১ = ৭.৮
সুতরাং, লোহার আপেক্ষিক গুরুত্ব হলো ৭.৮। তার মানে, লোহা পানির চেয়ে ৭.৮ গুণ ভারী।
২. আর্কিমিডিসের নীতি ব্যবহার করে আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ণয়
আর্কিমিডিসের নীতি ব্যবহার করে কঠিন বস্তুর আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ণয় করা যায়। এই পদ্ধতিতে প্রথমে বস্তুকে বাতাসে ওজন করতে হয়, তারপর পানিতে ডুবিয়ে ওজন নিতে হয়। এরপর নিচের সূত্র ব্যবহার করে আপেক্ষিক গুরুত্ব বের করা হয়:
আপেক্ষিক গুরুত্ব = (বস্তুর বাতাসে ওজন) / (বস্তুর বাতাসে ওজন - বস্তুর পানিতে ওজন)
এই পদ্ধতিতে আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ণয় করার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক:
- ধরা যাক, একটি পাথরের বাতাসে ওজন ৫০ গ্রাম।
- পাথরটিকে পানিতে ডোবানোর পর ওজন হলো ৩০ গ্রাম।
- তাহলে, আপেক্ষিক গুরুত্ব হবে: ৫০ / (৫০ – ৩০) = ৫০ / ২০ = ২.৫
সুতরাং, পাথরটির আপেক্ষিক গুরুত্ব হলো ২.৫।
৩. হাইড্রোমিটার দিয়ে আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ণয়
তরল পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্ব মাপার জন্য হাইড্রোমিটার ব্যবহার করা হয়। এটি একটি কাঁচের তৈরি যন্ত্র, যার মধ্যে একটি স্কেল থাকে। হাইড্রোমিটারকে তরলের মধ্যে ডুবালে স্কেলের যে দাগ পর্যন্ত ডুবে যায়, সেটিই হলো ওই তরলের আপেক্ষিক গুরুত্ব।
দুধের ভেজাল মাপার জন্য ল্যাক্টোমিটার নামক এক ধরনের হাইড্রোমিটার ব্যবহার করা হয়।
বিভিন্ন বস্তুর আপেক্ষিক গুরুত্ব (Relative Density of Different Materials)
বিভিন্ন বস্তুর আপেক্ষিক গুরুত্ব বিভিন্ন রকম হয়। নিচে কয়েকটি সাধারণ বস্তুর আপেক্ষিক গুরুত্বের তালিকা দেওয়া হলো:
বস্তু | আপেক্ষিক গুরুত্ব |
---|---|
সোনা | ১৯.৩ |
পারদ (Mercury) | ১৩.৬ |
সীসা (Lead) | ১১.৩ |
লোহা | ৭.৮ |
তামা (Copper) | ৮.৯ |
অ্যালুমিনিয়াম | ২.৭ |
কাঠ (বিভিন্ন প্রকার) | ০.৩ – ০.৯ |
বরফ | ০.৯২ |
পেট্রোল | ০.৭ |
ইথানল | ০.৭৯ |
এই তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, সোনার আপেক্ষিক গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তাই সোনা সবচেয়ে ভারী। আবার, কাঠের আপেক্ষিক গুরুত্ব কম হওয়ায় এটি পানিতে ভাসে।
আপেক্ষিক গুরুত্ব এবং প্লবতা (Relative Density and Buoyancy)
প্লবতা (Buoyancy) হলো কোনো বস্তুকে তরল বা গ্যাসীয় পদার্থে নিমজ্জিত করলে সেই বস্তু যে ঊর্ধ্বমুখী বল অনুভব করে। আপেক্ষিক গুরুত্বের সাথে প্লবতার একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
যদি কোনো বস্তুর আপেক্ষিক গুরুত্ব ১-এর কম হয়, তাহলে সেই বস্তু পানিতে ভাসবে। কারণ, বস্তুটির ঘনত্ব পানির চেয়ে কম। আবার, যদি আপেক্ষিক গুরুত্ব ১-এর বেশি হয়, তাহলে বস্তুটি পানিতে ডুবে যাবে। কারণ, বস্তুটির ঘনত্ব পানির চেয়ে বেশি। আর যদি আপেক্ষিক গুরুত্ব ১-এর সমান হয়, তাহলে বস্তুটি পানির মধ্যে ভাসতে থাকবে, কিন্তু ডুববে না।
এ কারণেই কাঠ পানিতে ভাসে, কিন্তু লোহা ডুবে যায়। কারণ, কাঠের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১-এর কম এবং লোহার আপেক্ষিক গুরুত্ব ১-এর বেশি।
তাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক গুরুত্ব (Temperature and Relative Density)
তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে সাথে বস্তুর ঘনত্ব পরিবর্তিত হয়। তাই আপেক্ষিক গুরুত্বও পরিবর্তিত হতে পারে। সাধারণত, তাপমাত্রা বাড়লে বস্তুর ঘনত্ব কমে যায় এবং আপেক্ষিক গুরুত্বও কমে যায়।
এজন্য আপেক্ষিক গুরুত্ব মাপার সময় তাপমাত্রা উল্লেখ করা জরুরি। কারণ, ভিন্ন তাপমাত্রায় একই বস্তুর আপেক্ষিক গুরুত্ব ভিন্ন হতে পারে।
আপেক্ষিক গুরুত্ব নিয়ে কিছু মজার তথ্য (Fun Facts about Relative Density)
আপেক্ষিক গুরুত্ব নিয়ে কিছু মজার তথ্য জেনে আপনার ভালো লাগতে পারে:
- মৃত সাগর (Dead Sea)-এর পানিতে লবণের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে এর ঘনত্ব বেশি। তাই এখানে মানুষ সহজে ডুবতে পারে না।
- বেলুনের মধ্যে হাইড্রোজেন গ্যাস ভরলে বেলুন আকাশে ওড়ে, কারণ হাইড্রোজেনের ঘনত্ব বাতাসের চেয়ে কম।
- একটি ডিম পানিতে ডুববে কিনা, তা ডিমের ভেতরের বাতাসের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। পুরনো ডিমের ভেতরে বাতাস বেশি থাকলে তা সহজে ভাসে।
আপেক্ষিক গুরুত্ব: কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
আপেক্ষিক গুরুত্ব নিয়ে আপনাদের মনে আরও কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে। তাই নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
আপেক্ষিক গুরুত্বের একক কি?
আপেক্ষিক গুরুত্বের কোনো একক নেই। এটি একটি dimensionless রাশি।
আপেক্ষিক গুরুত্ব কিভাবে মাপা হয়?
আপেক্ষিক গুরুত্ব মাপার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। ঘনত্ব জেনে, আর্কিমিডিসের নীতি ব্যবহার করে অথবা হাইড্রোমিটার দিয়ে এটি মাপা যায়।
সোনার আপেক্ষিক গুরুত্ব কত?
সোনার আপেক্ষিক গুরুত্ব হলো ১৯.৩।
আপেক্ষিক গুরুত্বের ব্যবহার কি কি?
বস্তুর বিশুদ্ধতা নির্ণয়, খনিজ পদার্থ সনাক্তকরণ, জাহাজ নির্মাণ এবং দৈনন্দিন জীবনে ভেজাল নির্ণয়ে আপেক্ষিক গুরুত্ব ব্যবহার করা হয়।
পানির আপেক্ষিক গুরুত্ব কত?
পানির আপেক্ষিক গুরুত্ব ১।
উপসংহার
আশা করি, আপেক্ষিক গুরুত্ব সম্পর্কে আপনার ধারণা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। আপেক্ষিক গুরুত্ব শুধু একটি সংজ্ঞা নয়, এটি আমাদের চারপাশের অনেক ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়। তাই, বিজ্ঞানকে আরও ভালোভাবে জানতে হলে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা রাখা জরুরি।
যদি এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর হ্যাঁ, এই পোস্টটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!
তাহলে, আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন!