আচ্ছা, কখনো কি ভেবেছেন, একটা পিঁপড়া কী দিয়ে তৈরি? নাকি ঐ বিশাল আকারের হাতিটা? অথবা ধরুন, আপনি নিজেই? এদের সবাই কিন্তু একটা বিশেষ শ্রেণীতে পরে। আর সেটাই হল বহুকোষী জীব। চলুন, আজ আমরা এই বহুকোষী জীব জগৎটা একটু ঘুরে আসি!
বহুকোষী জীব: জীবনের জটিল ধাঁধা
বহুকোষী জীব (Multicellular organism) মানেই হল সেই সব জীব, যাদের শরীর একটার বেশি কোষ দিয়ে তৈরি। “বহু” মানে অনেক, আর “কোষ” মানে তো জানেনই – আমাদের শরীরের একদম ছোট একক। তাহলে সোজা কথায়, যাদের অনেক কোষ, তারাই বহুকোষী।
বহুকোষী জীব কেন এত স্পেশাল?
এককোষী জীব (যেমন অ্যামিবা) একটা মাত্র কোষ দিয়ে সব কাজ করে। কিন্তু বহুকোষী জীবদের শরীরে আলাদা আলাদা কাজের জন্য আলাদা আলাদা কোষ থাকে। যেমন, আমাদের শরীরে পেশী কোষ (muscle cell) আছে নড়াচড়ার জন্য, স্নায়ু কোষ (nerve cell) আছে সংবেদনের জন্য, রক্ত কোষ (blood cell) আছে অক্সিজেন পরিবহনের জন্য। এই যে স্পেশালাইজেশন, এটাই বহুকোষী জীবদের জটিল কাজ করতে সাহায্য করে।
বহুকোষী জীবের বৈশিষ্ট্য
বহুকোষী জীবদের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, যা তাদের এককোষী জীব থেকে আলাদা করে:
- কোষের সংখ্যা: এদের শরীরে অসংখ্য কোষ থাকে। একটা মানুষের শরীরে প্রায় ৩৭ ট্রিলিয়ন (37,000,000,000,000) কোষ আছে!
- কোষের প্রকার: বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের কোষ থাকে। এই কোষগুলো টিস্যু (tissue) তৈরি করে, টিস্যুগুলো অঙ্গ (organ) তৈরি করে, আর অঙ্গগুলো মিলে তৈরি হয় একটা পুরো শরীর। একটু চিন্তা করুন, আপনার পাকস্থলী খাবার হজম করার জন্য, হৃদপিণ্ড রক্ত পাম্প করার জন্য – কী দারুণ সিস্টেম!
- কোষ বিভাজন: বহুকোষী জীবের শরীর বড় হওয়ার জন্য কোষ বিভাজন দরকার হয়। একটা ছোট বাচ্চা থেকে ধীরে ধীরে বড় হওয়া – এটা কোষ বিভাজনেরই কারসাজি।
- জীবনকাল: সাধারণত এককোষী জীবের থেকে বহুকোষী জীবের জীবনকাল বেশি হয়।
বহুকোষী জীব কত প্রকার ও কী কী?
এই পৃথিবীতে বহুকোষী জীবের সংখ্যা অগণিত! এদের মধ্যে কিছু প্রধান বিভাগ নিয়ে আলোচনা করা যাক:
উদ্ভিদজগৎ (Kingdom Plantae):
গাছপালা আমাদের চারপাশের অক্সিজেনের প্রধান উৎস। এরা সালোকসংশ্লেষণ (photosynthesis) প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলো ব্যবহার করে খাদ্য তৈরি করে।
- বৈশিষ্ট্য: এরা সাধারণত নিজেদের খাদ্য নিজেরাই তৈরি করতে পারে। এদের কোষপ্রাচীর (cell wall) সেলুলোজ (cellulose) দিয়ে তৈরি।
- উদাহরণ: আম গাছ, জাম গাছ, ধান গাছ, ঘাস – সবই বহুকোষী উদ্ভিদ।
প্রাণীজগৎ (Kingdom Animalia):
আমরা, মানে মানুষ, এবং অন্যান্য সব প্রাণী এই জগতের অন্তর্ভুক্ত।
- বৈশিষ্ট্য: এরা খাদ্য তৈরি করতে পারে না, তাই অন্য জীবের উপর নির্ভরশীল। এদের কোষে কোষপ্রাচীর থাকে না।
- উদাহরণ: বাঘ, সিংহ, হাতি, ঘোড়া, পাখি, মাছ, কীটপতঙ্গ – সবই বহুকোষী প্রাণী।
ছত্রাকজগৎ (Kingdom Fungi):
এরা উদ্ভিদও নয়, প্রাণীও নয় – একেবারে আলাদা একটা জগৎ!
- বৈশিষ্ট্য: এরা মৃত বা পচা জৈব পদার্থ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। এদের কোষপ্রাচীর কাইটিন (chitin) দিয়ে তৈরি।
- উদাহরণ: মাশরুম, পেনিসিলিয়াম (Penicillium), ঈস্ট (Yeast) – যদিও ঈস্ট মূলত একককোষী, কিছু ছত্রাক বহুকোষী হয়।
বহুকোষী জীবের উদ্ভব
এবার একটু গভীরে যাওয়া যাক। বহুকোষী জীব কিভাবে তৈরি হল, সেটা কি জানেন? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর আগে এককোষী জীব থেকে ধীরে ধীরে বহুকোষী জীবের উদ্ভব হয়েছে।
- সম্ভাব্য কারণ: সম্ভবত কিছু এককোষী জীব একসঙ্গে বসবাস করতে শুরু করে এবং একটা সময়ে তারা একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে কোষ বিভাজন এবং বিশেষ কাজে পারদর্শীতা (specialization) দেখা দেয়।
- গুরুত্ব: বহুকোষী জীবের উদ্ভব জীবনের ইতিহাসে একটা বিশাল পরিবর্তন এনেছে। এর ফলেই জটিল গঠন এবং কার্যাবলী সম্পন্ন জীব তৈরি হওয়া সম্ভব হয়েছে।
মানুষের জীবনে বহুকোষী জীবের প্রভাব
আমাদের জীবনে বহুকোষী জীবের প্রভাব ব্যাপক। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা – সব কিছুতেই এদের অবদান আছে।
খাদ্য হিসেবে:
ভাত, ডাল, সবজি, ফল, মাছ, মাংস – সবই বহুকোষী জীব থেকে আসে। এগুলো আমাদের শরীরের পুষ্টির চাহিদা মেটায়।
বস্ত্র হিসেবে:
তুলা গাছ থেকে আমরা তুলা পাই, যা দিয়ে কাপড় তৈরি হয়। এছাড়া রেশম কীট থেকে রেশম পাওয়া যায়, যা দিয়ে দামি কাপড় তৈরি হয়।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে:
বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং প্রাণী থেকে আমরা ঔষধ পাই। যেমন, পেনিসিলিয়াম নামক ছত্রাক থেকে পেনিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হয়, যা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে।
বাস্তুতন্ত্রে (Ecosystem) বহুকোষী জীবের ভূমিকা
বাস্তুতন্ত্রে বহুকোষী জীব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- খাদ্য শৃঙ্খল: এরা খাদ্য শৃঙ্খলের (food chain) একটা অপরিহার্য অংশ। উদ্ভিদ সূর্যের আলো থেকে খাদ্য তৈরি করে, যা প্রাণীরা খায়। আবার প্রাণীদের মাংসাশী প্রাণীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
- পরিবেশের ভারসাম্য: গাছপালা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ছাড়ে, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।
- মাটির উর্বরতা: মৃত জীবদেহ মাটিতে মিশে মাটিকে উর্বর করে তোলে, যা উদ্ভিদের জন্য খুব দরকারি।
বহুকোষী জীব নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- সবচেয়ে বড় বহুকোষী জীব হল নীল তিমি (Blue Whale)। এদের ওজন প্রায় ২০০ টন পর্যন্ত হতে পারে!
- সবচেয়ে লম্বা বহুকোষী জীব হল সিকোয়া গাছ (Sequoia tree)। এদের উচ্চতা প্রায় ২৭৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে!
- কিছু বহুকোষী জীব, যেমন স্পঞ্জ (Sponge), নিজেদের শরীরকে পুনর্গঠন করতে পারে। মানে, যদি তাদের শরীরকে ছোট ছোট অংশে কেটে ফেলা হয়, তবে তারা আবার জোড়া লেগে পুরো শরীর তৈরি করতে পারে!
বহুকোষী জীব নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এখানে বহুকোষী জীব নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল:
বহুকোষী জীব কিভাবে বংশবৃদ্ধি করে?
বহুকোষী জীব যৌন জনন (sexual reproduction) এবং অযৌন জনন (asexual reproduction) – এই দুই ভাবেই বংশবৃদ্ধি করতে পারে। যৌন জননে দুটি ভিন্ন জীবের প্রয়োজন হয়, যেখানে অযৌন জননে একটি জীবই বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীব কিভাবে আলাদা?
এককোষী জীব একটি মাত্র কোষ দিয়ে গঠিত, যেখানে বহুকোষী জীব অসংখ্য কোষ দিয়ে গঠিত। বহুকোষী জীবের কোষগুলো বিভিন্ন কাজ করার জন্য বিশেষায়িত (specialized) হয়, যা এককোষী জীবে দেখা যায় না। অনেকটা যেন একটা ছোট দোকানে একজন মালিক সবকিছু সামলাচ্ছেন, আর একটা বড় কোম্পানিতে আলাদা আলাদা কাজের জন্য আলাদা আলাদা বিভাগ আছে।
ভাইরাস কি বহুকোষী জীব?
ভাইরাস জীব নয়। এটি জীব এবং জড়ের মাঝে অবস্থান করে। ভাইরাসের নিজস্ব সেলুলার স্ট্রাকচার নেই এবং এটি প্রজননের জন্য অন্য জীবন্ত কোষের উপর নির্ভরশীল। তাই ভাইরাসকে বহুকোষী জীব বলা যায় না।
সবচেয়ে ছোট বহুকোষী জীব কোনটি?
সবচেয়ে ছোট বহুকোষী জীব হল মাইক্সোজোয়া (Myxozoa) পর্বের কিছু পরজীবী প্রাণী। এদের আকার খুবই ছোট হয়, কয়েক মাইক্রোমিটার থেকে কয়েক মিলিমিটার পর্যন্ত।
অ্যামিবা কি বহুকোষী জীব?
অ্যামিবা (Amoeba) একটি এককোষী জীব, বহুকোষী নয়। এটি প্রোটিস্টা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।
বহুকোষী জীবের উদাহরণ দাও?
মানুষ, গরু, ছাগল, পাখি, গাছপালা, পোকামাকড়, কেঁচো, তারা মাছ – এরা সবাই বহুকোষী জীবের উদাহরণ।
বহুকোষী প্রাণী কাকে বলে?
যেসব প্রাণীর শরীর একাধিক কোষ দিয়ে গঠিত, তাদের বহুকোষী প্রাণী বলে। এদের শরীরে বিভিন্ন প্রকার কোষ বিভিন্ন কাজ সম্পাদনের জন্য বিশেষায়িত থাকে।
সপুষ্পক উদ্ভিদ বহুকোষী কেন?
সপুষ্পক উদ্ভিদ (flowering plant) বহুকোষী কারণ এদের শরীর অসংখ্য কোষ দিয়ে গঠিত এবং এই কোষগুলো বিভিন্ন টিস্যু ও অঙ্গ তৈরি করে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজ করে থাকে। এরা ফুল ও ফলের মাধ্যমে প্রজনন করে।
উপসংহার
তাহলে, বহুকোষী জীব মানেই হল জটিলতা, বৈচিত্র্য আর জীবনের এক অপূর্ব প্রকাশ। আমাদের চারপাশের এই জীব জগৎটার দিকে একটু ভালো করে তাকালেই বুঝতে পারবেন, প্রতিটি জীবের মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রকৃতির অপার রহস্য। আপনিও সেই রহস্যের একটা অংশ!
কেমন লাগলো আজকের আলোচনা? বহুকোষী জীব নিয়ে আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর যদি মনে হয় এই লেখাটি আপনার বন্ধুদের কাজে লাগবে, তাহলে অবশ্যই শেয়ার করুন! ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন!