শুরুতেই একটা প্রশ্ন করি, কখনও কি বৃষ্টির দিনে নরম ঘাসের উপর হেঁটেছেন? কেমন একটা ভেজা ভেজা অনুভূতি, তাই না? আর সেই ঘাসের মধ্যেই উঁকি দেয় ছোট্ট ছাতা, ঠিক যেন পরীর রাজ্যের বাসিন্দা! হ্যাঁ, আমি সেই ছত্রাকের কথাই বলছি। কিন্তু ছত্রাক আসলে কী? শুধু কি এরা দেখতেই সুন্দর, নাকি এদের অন্য কোনো ভূমিকাও আছে আমাদের জীবনে? চলুন, আজ ছত্রাকের দুনিয়ায় একটু ঢুঁ মেরে আসি!
ছত্রাক: প্রকৃতির এক বিস্ময়
ছত্রাক (Fungi) হলো জীবন্ত অর্গানিজমের একটি বিশাল রাজ্য। এরা উদ্ভিদ বা প্রাণী নয়, সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগৎ। এদের বৈশিষ্ট্য এতটাই ভিন্ন যে বিজ্ঞানীরা এদের জন্য আলাদা রাজ্যের (Kingdom) সৃষ্টি করেছেন। ছত্রাকেরা মৃত বা পচনশীল জৈব পদার্থ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। ভাবছেন, তাহলে তো এরা খারাপ? একদমই না! আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এদের ভূমিকা অনেক।
ছত্রাকের বৈশিষ্ট্য
ছত্রাককে ভালোভাবে জানতে হলে এর কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার, তাই না?
- কোষীয় গঠন: ছত্রাকের কোষ ইউক্যারিওটিক, অর্থাৎ এদের কোষে নিউক্লিয়াস ঝিল্লি দিয়ে ঘেরা থাকে।
- কোষ প্রাচীর: এদের কোষ প্রাচীর কাইটিন (Chitin) নামক উপাদান দিয়ে তৈরি। এই কাইটিন পোকামাকড়ের শরীরের বাইরের আবরণেও পাওয়া যায়।
- খাদ্য গ্রহণ: ছত্রাক সাধারণত শোষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ করে। এদের দেহে ক্লোরোফিল না থাকায় এরা সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে না।
- বংশবৃদ্ধি: এরা স্পোর ( spore ) তৈরির মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। স্পোর হলো ছোট ছোট বীজকোষের মতো, যা বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং নতুন ছত্রাকের জন্ম দেয়।
ছত্রাকের প্রকারভেদ
ছত্রাক বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এদের গঠন, খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং বংশবৃদ্ধির ধরনের ওপর ভিত্তি করে এদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
- ইস্ট (Yeast): এরা একককোষী ছত্রাক। রুটি তৈরি থেকে শুরু করে বিয়ার তৈরিতে এদের ব্যবহার করা হয়।
- মোল্ড (Mold): এরা বহুকোষী এবং সাধারণত ভেজা ও স্যাঁতসেঁতে জায়গায় জন্মায়। পাউরুটিতে যে সবুজ বা নীল রঙের ছোপ দেখেন, তা আসলে মোল্ড।
- মাশরুম (Mushroom): এরা বহুকোষী এবং এদের ফলনশীল অংশটি আমরা সাধারণত দেখতে পাই। কিছু মাশরুম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়, আবার কিছু বিষাক্তও হতে পারে।
ছত্রাকের গুরুত্ব
ভাবছেন, ছত্রাক শুধু পচা জিনিস খায় আর দেখতে বিদঘুটে? তাহলে ভুল করছেন! আমাদের জীবনে ছত্রাকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
- পরিবেশ রক্ষায়: ছত্রাক মৃত জীবদেহ এবং অন্যান্য জৈব পদার্থ decomposition বা বিয়োজন করে পরিবেশকে পরিষ্কার রাখে। এরা জটিল জৈব যৌগগুলোকে ভেঙে সরল উপাদানে পরিণত করে, যা পরবর্তীতে গাছপালা ব্যবহার করতে পারে।
- খাদ্য হিসেবে: মাশরুম একটি উৎকৃষ্ট খাদ্য। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল রয়েছে৷
- ঔষধ তৈরিতে: পেনিসিলিন নামক জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিয়াম নামক ছত্রাক থেকে তৈরি করা হয়। এছাড়া আরও অনেক ছত্রাক ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
- শিল্পে: ইস্ট নামক ছত্রাক রুটি, বিয়ার, ভিনেগার এবং অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
ছত্রাক নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
ছত্রাক নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। তাই কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাক।
ছত্রাক কি উদ্ভিদ?
না, ছত্রাক উদ্ভিদ নয়। আগে এদেরকে উদ্ভিদের রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হতো, কিন্তু এদের গঠন, খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং বংশবৃদ্ধির ধরন উদ্ভিদের থেকে আলাদা হওয়ায় এদের জন্য আলাদা রাজ্যের সৃষ্টি করা হয়েছে।
সব ছত্রাক কি খাবার যোগ্য?
একেবারেই না! কিছু ছত্রাক খাবার যোগ্য, যেমন মাশরুম। তবে অনেক ছত্রাক আছে যা বিষাক্ত এবং খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি হতে পারে। তাই জংলি মাশরুম চিনে না খেলে খাওয়া উচিত না।
ছত্রাক আমাদের কী ক্ষতি করতে পারে?
কিছু ছত্রাক মানুষের শরীরে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, দাদ (Ringworm), ছুলি (Tinea versicolor) ইত্যাদি ছত্রাক সংক্রমণের কারণে হয়। এছাড়াও, কিছু ছত্রাক খাবারে মিশে গেলে তা বিষাক্ত হয়ে যেতে পারে।
ছত্রাক কিভাবে বংশবৃদ্ধি করে?
ছত্রাক প্রধানত স্পোর তৈরির মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। স্পোরগুলো বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনুকূল পরিবেশে নতুন ছত্রাকের জন্ম দেয়। এছাড়াও, কিছু ছত্রাক খণ্ডন (fragmentation) প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও বংশবৃদ্ধি করতে পারে। যেখানে একটি ছত্রাকের অংশ ভেঙে গিয়ে নতুন ছত্রাকের জন্ম দেয়।
বাংলাদেশে ছত্রাক
বাংলাদেশের আবহাওয়া ছত্রাক জন্মানোর জন্য বেশ উপযোগী। এখানে বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক দেখা যায়, যার মধ্যে কিছু খাবার যোগ্য এবং কিছু বিষাক্ত।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাশরুম চাষ
মাশরুম চাষ বাংলাদেশে একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। অল্প জায়গায় এবং কম খরচে মাশরুম চাষ করে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মাশরুমের চাষ হয়, যেমন:
- ওয়েস্টার মাশরুম
- শীতকে মাশরুম
- মিল্কি মাশরুম
বাংলাদেশের বিষাক্ত ছত্রাক
বাংলাদেশে কিছু বিষাক্ত ছত্রাকও পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কিছু দেখতে সাধারণ মাশরুমের মতোই, তাই এদের চেনা খুব কঠিন। বিষাক্ত ছত্রাক খেলে বমি, ডায়রিয়া, পেট ব্যথা থেকে শুরু করে লিভারের মারাত্মক ক্ষতি এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
ছত্রাক: কিছু মজার তথ্য
- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জীবন্ত অর্গানিজম হলো একটি ছত্রাক! এটি যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগনে অবস্থিত এবং প্রায় ২,২০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।
- আলো ছাড়াই ছত্রাক বাঁচতে পারে। কারণ এরা সালোকসংশ্লেষণ করে না।
- কিছু ছত্রাক পোকামাকড়কে আক্রমণ করে এবং তাদের শরীর থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে। এদেরকে এন্টোমো প্যাথোজেনিক ফাঙ্গি (Entomopathogenic fungi) বলা হয়।
শেষ কথা
ছত্রাক আমাদের চারপাশের পরিবেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা থেকে শুরু করে খাদ্য এবং ঔষধ তৈরিতে এদের অবদান অনস্বীকার্য। তবে সব ছত্রাক নিরাপদ নয়, তাই এদের সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে ব্যবহার করা উচিত।
আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে আপনি ছত্রাক সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন। আপনার যদি আরও কিছু জানার থাকে, তবে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আর হ্যাঁ, প্রকৃতির এই বিস্ময়কর জগৎ নিয়ে আরও জানতে চোখ রাখুন আমাদের ব্লগে। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন!