আচ্ছা, চুম্বক নিয়া খেলতে কেমন লাগে? ছোটবেলায় নিশ্চয়ই চুম্বক দিয়া লোহা জড়ো করার চেষ্টা করছেন, অথবা চুম্বক দিয়া কম্পাস বানানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু কখনো কি ভাইবা দেখছেন, এই চুম্বক জিনিসটা আসলে কী? আজকে আমরা চুম্বকত্ব (chumboktto) নিয়া খোলাখুলি আলোচনা করবো, একদম সহজ ভাষায়। চলেন, শুরু করা যাক!
চুম্বকত্ব: একদম বেসিক থিওরি
চুম্বকত্ব হইল একটা বিশেষ শক্তি। এই শক্তির কারণে কিছু জিনিস, যেমন লোহা, নিকেল, কোবাল্ট – এগুলা চুম্বকের দিকে আকৃষ্ট হয়। সোজা কথায়, চুম্বকত্ব একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার!
চুম্বক কী?
চুম্বক হইল সেই বস্তু, যার মধ্যে চুম্বকত্ব দেখা যায়। একটা চুম্বকের দুইটা মেরু থাকে – উত্তর মেরু (North Pole) আর দক্ষিণ মেরু (South Pole)। মজার ব্যাপার হইল, একই মেরুগুলো পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, আর বিপরীত মেরুগুলো আকর্ষণ করে। মানে, নর্থ পোল নর্থ পোলকে ধাক্কা দিবে, কিন্তু নর্থ পোল সাউথ পোলকে কাছে টানবে। চুম্বকের এই আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করার ক্ষমতাকেই চুম্বকত্ব বলে।
চুম্বকত্বের প্রকারভেদ
চুম্বকত্ব মূলত দুই প্রকার:
-
স্থায়ী চুম্বকত্ব (Permanent Magnetism): কিছু জিনিস প্রাকৃতিকভাবেই চুম্বক হিসাবে থাকে। যেমন, লোহা বা নিকেল জাতীয় পদার্থ যখন বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়, তখন তারা স্থায়ী চুম্বকে পরিণত হয়। এগুলোর চুম্বকত্ব সহজে নষ্ট হয় না।
-
অস্থায়ী চুম্বকত্ব (Temporary Magnetism): কিছু জিনিস আছে, যারা সবসময় চুম্বক নয়, কিন্তু যখন তাদের চুম্বকের কাছে আনা হয়, তখন তারা কিছু সময়ের জন্য চুম্বকের মতো আচরণ করে। যেমন, নরম লোহা। চুম্বক সরিয়ে নিলেই এদের চুম্বকত্ব শেষ।
চুম্বকত্ব কিভাবে কাজ করে?
চুম্বকত্বের মূলে আছে পরমাণুর ইলেকট্রনের ঘূর্ণন। প্রত্যেকটা পরমাণুতে ইলেকট্রন নামক ছোট ছোট কণা থাকে, যারা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে। এই ঘূর্ণনের কারণে একটা ছোট চুম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়।
পরমাণুর ঘূর্ণন এবং চুম্বক ক্ষেত্র
সাধারণত, একটা বস্তুর মধ্যে এই ইলেকট্রনগুলো এলোমেলোভাবে ঘোরে, তাই তাদের চুম্বক ক্ষেত্রগুলো একে অপরের প্রভাব বাতিল করে দেয়। কিন্তু চুম্বকের ক্ষেত্রে, অনেকগুলো ইলেকট্রন একই দিকে ঘুরতে থাকে। এর ফলে একটা শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়, যা অন্য বস্তুকে আকর্ষণ করতে পারে।
ডোমেইন তত্ত্ব (Domain Theory)
ডোমেইন তত্ত্ব অনুযায়ী, চুম্বকীয় পদার্থ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডোমেইন দিয়ে গঠিত। প্রতিটি ডোমেইনে ইলেকট্রনগুলো একই দিকে স্পিন করে, যার ফলে এটি একটি ক্ষুদ্র চুম্বক হিসেবে কাজ করে। যখন একটি চুম্বকীয় পদার্থকে কোনো চুম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে রাখা হয়, তখন এই ডোমেইনগুলো সারিবদ্ধ হয়ে যায়, এবং পদার্থটি চুম্বকত্ব লাভ করে।
চুম্বকত্বের ব্যবহার
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চুম্বকের ব্যবহার ব্যাপক। নিচে কয়েকটি প্রধান ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:
- কম্পাস: দিক নির্ণয়ের জন্য কম্পাস ব্যবহার করা হয়। কম্পাসের কাঁটা একটা ছোট চুম্বক, যা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকে মুখ করে থাকে।
- মোটর ও জেনারেটর: বৈদ্যুতিক মোটর এবং জেনারেটরের মূল উপাদান হল চুম্বক। এই দুইটি যন্ত্রে চুম্বকীয় ক্ষেত্র ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং যান্ত্রিক শক্তি তৈরি করা হয়।
- স্পিকার ও মাইক্রোফোন: স্পিকার এবং মাইক্রোফোনে চুম্বক এবং কয়েলের মাধ্যমে শব্দ তৈরি এবং গ্রহণ করা হয়।
- হার্ড ড্রাইভ: কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভে তথ্য সংরক্ষণের জন্য চুম্বকীয় ক্ষেত্র ব্যবহার করা হয়।
- মেডিক্যাল ইমেজিং: এমআরআই (MRI) মেশিনে শক্তিশালী চুম্বক ব্যবহার করে শরীরের ভেতরের ছবি তোলা হয়।
- ক্রেডিট কার্ড ও এটিএম কার্ড: এই কার্ডগুলোর পিছনে একটি ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ থাকে, যেখানে তথ্য সংরক্ষিত থাকে।
চুম্বকত্ব এবং বিদ্যুৎ
চুম্বকত্ব আর বিদ্যুতের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে। বিজ্ঞানী অ্যারস্টেড (Oersted) প্রথম দেখান যে, যখন কোনো তারের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ যায়, তখন তার চারপাশে একটা চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই আবিষ্কার থেকেই পরবর্তীতে তড়িৎ চুম্বকের (Electromagnet) ধারণা আসে।
তড়িৎ চুম্বক (Electromagnet)
তড়িৎ চুম্বক হলো এমন একটি যন্ত্র, যেখানে বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। একটি তারকে কয়েলের মতো পেঁচিয়ে তার মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ চালনা করলে এটি চুম্বকের মতো আচরণ করে। বিদ্যুতের প্রবাহ বন্ধ করে দিলে চুম্বকত্বও চলে যায়।
ফ্যারাডের সূত্র (Faraday’s Law)
ফ্যারাডের সূত্র অনুযায়ী, যখন কোনো পরিবাহী (conductor) চুম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে গতিশীল হয়, তখন সেই পরিবাহীতে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই জেনারেটর তৈরি করা হয়, যা যান্ত্রিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে।
চুম্বক নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- পৃথিবী নিজেই একটা বিশাল চুম্বক। এর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে চুম্বক ক্ষেত্র রয়েছে।
- কিছু পাখি এবং কচ্ছপ পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে দিক নির্ণয় করে।
- চুম্বক মেরুর কাছাকাছি সবচেয়ে শক্তিশালী হয়।
চুম্বকত্ব নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQs)
চুম্বক কিভাবে তৈরি হয়?
চুম্বক সাধারণত লোহা, নিকেল, কোবাল্ট ইত্যাদি চুম্বকীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রথমে এই পদার্থগুলোকে একটি শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে রাখা হয়, যার ফলে তাদের পরমাণুগুলো সারিবদ্ধ হয়ে যায়। এরপর এগুলোকে উত্তপ্ত করে ধীরে ধীরে ঠান্ডা করা হয়, যাতে পরমাণুগুলোর সারিবদ্ধ অবস্থা বজায় থাকে।
চুম্বকের শক্তি কিভাবে মাপা হয়?
চুম্বকের শক্তি সাধারণত টেসলা (Tesla) অথবা গাউস (Gauss) এককে মাপা হয়। এই এককগুলো চুম্বক ক্ষেত্রের তীব্রতা নির্দেশ করে।
চুম্বক কি লোহা ছাড়া অন্য কিছুকে আকর্ষণ করে?
হ্যাঁ, চুম্বক লোহা ছাড়াও নিকেল, কোবাল্ট এবং কিছু বিশেষ ধরণের ধাতু ও সংকর ধাতু (alloy) কে আকর্ষণ করে।
চুম্বককে গরম করলে কি হয়?
চুম্বককে অত্যাধিক গরম করলে এর চুম্বকত্ব নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কারণ, তাপের কারণে পরমাণুগুলোর মধ্যেকার সারিবদ্ধতা ভেঙে যায়।
পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্র কিভাবে তৈরি হয়েছে?
বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীর কেন্দ্রের গলিত লোহার ঘূর্ণনের কারণে এই চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এই ঘূর্ণন একটি ডায়নামোর মতো কাজ করে, যা বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে এবং চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে।
চুম্বকত্ব কিভাবে কাজ করে?
চুম্বকত্বের মূলে আছে পরমাণুর ইলেকট্রনের স্পিন। প্রত্যেকটা পরমাণুতে ইলেকট্রন নামক ছোট ছোট কণা থাকে, যারা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে। এই ঘূর্ণনের কারণে একটা ছোট চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়।
চৌম্বক পদার্থের উদাহরণ কি?
কিছু সাধারণ চৌম্বক পদার্থের উদাহরণ হল লোহা, নিকেল, কোবাল্ট এবং গ্যাডোলিনিয়াম। এছাড়াও কিছু মিশ্রণ এবং যৌগ আছে যা চৌম্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে।
চুম্বক কিভাবে তৈরি হয়?
চুম্বক সাধারণত চৌম্বকীয় পদার্থ যেমন লোহা, নিকেল বা কোবাল্টকে একটি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে রেখে তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় পদার্থের অণুগুলো সারিবদ্ধ হয়ে স্থায়ী চৌম্বকত্ব তৈরি করে।
চুম্বক কত প্রকার ও কি কি?
চুম্বক প্রধানত দুই প্রকার: স্থায়ী চুম্বক এবং অস্থায়ী চুম্বক। স্থায়ী চুম্বক তার চৌম্বকত্ব ধরে রাখে, যেখানে অস্থায়ী চুম্বক শুধুমাত্র চৌম্বক ক্ষেত্রের উপস্থিতিতে চৌম্বকীয় বৈশিষ্ট্য দেখায়।
চুম্বকীয় বল কাকে বলে?
চুম্বকীয় বল হল সেই আকর্ষণ বা বিকর্ষণ শক্তি যা চুম্বক দ্বারা অন্য চৌম্বক পদার্থ বা চলমান বৈদ্যুতিক চার্জের উপর প্রযুক্ত হয়। এই বল চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে কাজ করে।
চুম্বকীয় ক্ষেত্র কাকে বলে?
চুম্বকীয় ক্ষেত্র হল চুম্বকের চারপাশে তৈরি হওয়া একটি অঞ্চল, যেখানে অন্য কোনো চুম্বক বা চৌম্বক পদার্থ আনলে তার উপর বল প্রযুক্ত হয়। এই ক্ষেত্র চুম্বকের মেরুগুলোর মধ্যে বিস্তৃত থাকে।
শেষ কথা
চুম্বকত্ব (chumboktto) একটা মজার এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা শুধু লোহাকে আকর্ষণ করে না, আমাদের জীবনযাত্রার অনেক ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার রয়েছে। আশা করি আজকের আলোচনা থেকে আপনারা চুম্বকত্ব সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা পেয়েছেন। এই বিষয়ে আরও কিছু জানতে চান? নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন! আর এই ব্লগটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। হ্যাপি লার্নিং!