শুরু করা যাক!
আচ্ছা, ব্যাকরণ নিয়ে ভয় লাগে? বিশেষ করে “পদ” ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে লাগে, তাই না? চিন্তা নেই! আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা “পদ কাকে বলে (কত প্রকার ও কি কি)” – এই নিয়ে সহজভাবে আলোচনা করব। যেন চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছি, ঠিক তেমন করে। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
পদ: শব্দের রূপকথা
আচ্ছা, প্রথমে একটা মজার গল্প বলি। ধরুন, আপনি একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছেন। সেখানে নানা ধরনের মানুষ – কেউ বর, কেউ কনে, কেউবা বন্ধু-বান্ধব। আবার খাবার টেবিলে কত রকমের পদ – পোলাও, বিরিয়ানি, মাছ, মাংস! ব্যাকরণের “পদ” অনেকটা তেমনই। একটা বাক্যে শব্দগুলো যখন বিভিন্ন ভূমিকা নেয়, তখন তাদের এক একটা পদ বলা হয়।
ব্যাকরণে পদ মানে কী?
সহজ ভাষায়, বাক্যে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি শব্দই এক একটি পদ। কিন্তু কেন? কারণ বাক্যের মধ্যে প্রত্যেকটা শব্দের একটা নির্দিষ্ট কাজ থাকে। কোনোটা বিশেষ্য (নাম), কোনোটা বিশেষণ (গুণ), আবার কোনোটা ক্রিয়া (কাজ)। এই যে বিভিন্ন কাজ, এটাই শব্দগুলোকে পদে পরিণত করে।
পদ কত প্রকার ও কি কি?
বাংলা ব্যাকরণে পদ প্রধানত পাঁচ প্রকার:
- বিশেষ্য পদ (Noun)
- সর্বনাম পদ (Pronoun)
- বিশেষণ পদ (Adjective)
- ক্রিয়া পদ (Verb)
- অব্যয় পদ (Adverb)
বিশেষ্য পদ: নামের খেলা
কোনো ব্যক্তি, বস্তু, স্থান, জাতি, সমষ্টি, ভাব, কর্ম বা গুণের নাম বোঝায়, তাকে বিশেষ্য পদ বলে। সহজ কথায়, যা কিছু নামবাচক, তাই বিশেষ্য।
বিশেষ্য পদের প্রকারভেদ:
বিশেষ্য পদকে সাধারণত ছয় ভাগে ভাগ করা যায়:
- নামবাচক বা সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য (Proper Noun): কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, স্থান, নদী, পর্বত, ইত্যাদি বোঝায়। যেমন: ঢাকা, পদ্মা, হিমালয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- জাতিবাচক বিশেষ্য (Common Noun): সমগ্র জাতি বা শ্রেণীকে বোঝায়। যেমন: মানুষ, পাখি, নদী, পর্বত।
- বস্তুবাচক বা দ্রব্যবাচক বিশেষ্য (Material Noun): কোনো বস্তু বা উপাদান বোঝায়। যেমন: চাল, ডাল, চিনি, পানি।
- সমষ্টিবাচক বিশেষ্য (Collective Noun): কোনো দল বা সমষ্টি বোঝায়। যেমন: সমিতি, দল, পঞ্চায়েত, মাহফিল।
- ভাববাচক বিশেষ্য (Abstract Noun): কোনো গুণ, অবস্থা বা কাজের নাম বোঝায়। যেমন: সুখ, দুঃখ, কান্না, হাসি, তারুণ্য।
- গুণবাচক বিশেষ্য: রূপ, রং, স্বাদ ইত্যাদি বোঝায়। যেমন: মধুরতা, তিক্ততা, শীতলতা, স্বচ্ছতা।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে, তাই না?
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন।” এখানে, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর” নামবাচক বিশেষ্য এবং “কবি” জাতিবাচক বিশেষ্য।
সর্বনাম পদ: নামের বদলে যে আসে
বিশেষ্যের বদলে যে শব্দ ব্যবহৃত হয়, তাকে সর্বনাম পদ বলে। ধরুন, আপনি আপনার বন্ধুর কথা বলছেন। প্রতিবার তার নাম না বলে “সে”, “তিনি” ইত্যাদি ব্যবহার করছেন। এগুলোই সর্বনাম।
সর্বনাম পদের প্রকারভেদ:
বাংলা ব্যাকরণে সর্বনাম পদকে আট ভাগে ভাগ করা যায়:
- ব্যক্তিবাচক সর্বনাম (Personal Pronoun): আমি, আমরা, তুমি, তোমরা, সে, তারা, তিনি, আপনি।
- আত্মবাচক সর্বনাম (Reflexive Pronoun): আপনি, স্বয়ং, নিজ। (তিনি নিজে কাজটি করেছেন)
- নির্দেশক সর্বনাম (Demonstrative Pronoun): এই, ঐ, এরা, ওরা। (ঐ লোকটা কে?)
- অনির্দিষ্ট সর্বনাম (Indefinite Pronoun): কেউ, কিছু, একজন, যে কেউ। (কে যেন ডাকছে।)
- প্রশ্নবাচক সর্বনাম (Interrogative Pronoun): কে, কী, কাকে, কার। (তুমি কাকে চাও?)
- সম্বন্ধবাচক সর্বনাম (Relative Pronoun): যে, যিনি, যা, যারা। (যিনি পরিশ্রম করেন, তিনি সফল হন।)
- সাকল্যবাচক সর্বনাম: সব, সকল, সমুদয়, সবকিছু। (এখানে সবকিছু পাওয়া যায়।)
- অনাত্মবাচক সর্বনাম: অন্য, পর। (নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে।)
বিশেষণ পদ: গুণগান গাই যে
যে পদ বিশেষ্য, সর্বনাম বা ক্রিয়া পদের দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করে, তাকে বিশেষণ পদ বলে। এটা অনেকটা সিনেমার ট্রেলারের মতো – যা দেখে আপনি বুঝতে পারেন সিনেমাটা কেমন হতে পারে।
বিশেষণ পদের প্রকারভেদ:
বিশেষণ পদ প্রধানত দুই প্রকার:
- নাম-বিশেষণ: যা বিশেষ্য বা সর্বনাম পদকে বিশেষিত করে।
- রূপবাচক: সুন্দর ফুল, সবুজ মাঠ।
- গুণবাচক: ভালো ছেলে, সৎ মানুষ।
- অবস্থাবাচক: তাজা মাছ, শুকনো কাঠ।
- সংখ্যাবাচক: এক জন, দশটি পাতা।
- পরিমাণবাচক: অনেক চিনি, কিছু চাল।
- ক্রমবাচক: প্রথম শ্রেণী, দ্বিতীয় সন্তান।
- প্রশ্নবাচক: কেমন ছেলে, কত দূর।
- উপসর্গযোগে গঠিত: অপয়া ছেলে, নিখুঁত কাজ।
- অব্যয়যোগে গঠিত: গেঁয়ো যোগী, ভেতো বাঙালি।
- ভাব-বিশেষণ: যা ক্রিয়া বা অন্য কোনো বিশেষণ পদকে বিশেষিত করে।
- ক্রিয়া-বিশেষণ: ধীরে হাঁটো, জোরে বলো।
- বিশেষণের বিশেষণ: খুব ভালো, অতি মিষ্টি।
- অব্যয়ের বিশেষণ: ঠিক উপরে, বেশ ভালো।
- অনুরূপ ভাব বিশেষণ: ধীরে ধীরে যায়, ভয়ে ভয়ে কথা কয়।
ক্রিয়া পদ: কাজের কথা
যে পদ দ্বারা কোনো কাজ করা বোঝায়, তাকে ক্রিয়া পদ বলে। যেমন: যাওয়া, খাওয়া, করা, বলা, ইত্যাদি। এটা অনেকটা ইঞ্জিনের মতো – যা ছাড়া গাড়ি চলবে না, বাক্যও তেমন ক্রিয়া ছাড়া সম্পূর্ণ নয়।
ক্রিয়া পদের প্রকারভেদ:
ক্রিয়া পদকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাগ করা যায়:
- অর্থ বা ভাব অনুযায়ী ক্রিয়া:
- সকর্মক ক্রিয়া (Transitive Verb): কর্ম আছে। (যেমন: আমি ভাত খাই।)
- অকর্মক ক্রিয়া (Intransitive Verb): কর্ম নেই। (যেমন: সে হাসে।)
- দ্বিকর্মক ক্রিয়া: দুইটি কর্ম থাকে। (বাবা আমাকে একটি কলম দিয়েছেন।)
- গঠন অনুযায়ী ক্রিয়া:
- সরল ক্রিয়া: একটি মাত্র ধাতু থাকে। (যেমন: সে যায়।)
- যৌগিক ক্রিয়া: একাধিক ধাতু যুক্ত থাকে। (যেমন: সে যেতে লাগলো।)
- কাল বা সময় অনুযায়ী ক্রিয়া:
- বর্তমান কাল: করি, পড়ি, যাই।
- অতীত কাল: করেছিলাম, পড়েছিলাম, গিয়েছিলাম।
- ভবিষ্যৎ কাল: করিব, পড়িব, যাইব।
- অন্যান্য প্রকার:
- প্রযোজক ক্রিয়া: যখন কর্তা নিজে কাজ না করে অন্যকে দিয়ে করায়। (মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন।)
- নামধাতুর ক্রিয়া: বিশেষ্য, বিশেষণ বা ধ্বন্যাত্মক শব্দের পরে “আ” প্রত্যয় যোগ করে গঠিত। (বেত মারা = বেতা, ঘুমা = ঘুম)
অব্যয় পদ: যা বদলায় না
যে পদের কোনো পরিবর্তন হয় না, অর্থাৎ লিঙ্গ, বচন, কাল, কারক ভেদে যার রূপের কোনো বদল হয় না, তাকে অব্যয় পদ বলে। এটা অনেকটা ফ্রিজের মতো – সবকিছু যেমন আছে তেমনই থাকে, কোনো পরিবর্তন নেই।
অব্যয় পদের প্রকারভেদ:
অব্যয় পদকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা যায়:
- সংযোজক অব্যয় (Conjunction): দুটি শব্দ বা বাক্যকে যুক্ত করে। যেমন: এবং, ও, কিন্তু, অথবা। (যেমন: রহিম এবং করিম দুই ভাই।)
- বিয়োজক অব্যয়: দুটি জিনিসের মধ্যে বিয়োগ ঘটায়। যেমন: নতুবা, অথবা। (আজ যাব, নতুবা কাল।)
- অনন্বয়ী অব্যয়: বাক্যের অন্য পদের সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে স্বাধীনভাবে অর্থ প্রকাশ করে। যেমন: ছিঃ! কী নোংরা।
- অনুসর্গ অব্যয়: যা বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের পরে বসে তাদের অর্থ প্রকাশে সাহায্য করে। যেমন: দ্বারা, দিয়া, হতে, থেকে, চেয়ে। (যেমন: মেঘ থেকে বৃষ্টি পড়ে।)
“পদ” নিয়ে কিছু দরকারি কথা
- একটা শব্দ বাক্যে ব্যবহারের আগে শুধু শব্দই থাকে, পদ হয়ে ওঠে বাক্যে ব্যবহৃত হওয়ার পরেই।
- একই শব্দ বিভিন্ন বাক্যে বিভিন্ন পদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন, “ভালো” একটি বাক্যে বিশেষণ আবার অন্য বাক্যে বিশেষ্য হতে পারে।
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
১. পদ কত প্রকার?
উত্তর: পদ প্রধানত পাঁচ প্রকার: বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়া ও অব্যয়।
২. বিশেষ্য পদ কাকে বলে?
উত্তর: কোনো ব্যক্তি, বস্তু, স্থান, জাতি, সমষ্টি, ভাব, কর্ম বা গুণের নাম বোঝায়, তাকে বিশেষ্য পদ বলে।
৩. ক্রিয়া পদের উদাহরণ দিন।
উত্তর: খাওয়া, যাওয়া, করা, বলা – এগুলো সবই ক্রিয়া পদের উদাহরণ। “আমি ভাত খাই” – এখানে “খাই” হলো ক্রিয়া পদ।
৪. অব্যয় পদের কাজ কী?
উত্তর: অব্যয় পদ বাক্যের অন্য পদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে এবং বাক্যের অর্থকে স্পষ্ট করে। এর নিজের কোনো পরিবর্তন হয় না।
৫. সর্বনাম পদের প্রয়োজনীয়তা কী?
উত্তর: সর্বনাম পদ বিশেষ্যের পুনরাবৃত্তি কমায় এবং বাক্যকে শ্রুতিমধুর করে।
৬. বিশেষণ পদ কিভাবে বিশেষ্য পদকে বিশেষিত করে?
উত্তর: বিশেষণ পদ বিশেষ্য পদের গুণ, দোষ, অবস্থা, সংখ্যা বা পরিমাণ উল্লেখ করে তাকে বিশেষিত করে।
শেষ কথা
আশা করি, “পদ কাকে বলে (কত প্রকার ও কি কি)” – এই নিয়ে আপনার মনে আর কোনো ধোঁয়াশা নেই। ব্যাকরণের এই অংশটি ভালোভাবে বুঝতে পারলে বাংলা ভাষা আপনার কাছে আরও সহজ হয়ে উঠবে। ব্যাকরণের নিয়মগুলো যেন আপনার ভাষার পথে বন্ধু হয়ে ওঠে, বোঝা নয়। তাহলে, আজ এই পর্যন্তই! ভালো থাকুন, শিখতে থাকুন!
যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আপনার মতামত আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান।