জুম চাষ: পাহাড়ের বুকে সবুজের হাতছানি – পদ্ধতি, সুবিধা ও অসুবিধা
জুম চাষ! নামটা শুনলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাহাড়, সবুজ আর প্রকৃতির এক মায়াবী জগৎ। যারা প্রকৃতি ভালোবাসেন, পাহাড় ভালোবাসেন, তাদের কাছে জুম চাষ ব্যাপারটা বেশ আগ্রহের। তাহলে চলুন, আজ আমরা জুম চাষের অন্দরমহলে ডুব দেই, খুঁটিনাটি সবকিছু জেনে আসি।
জুম চাষ কি? (What is Jhum Cultivation?)
জুম চাষ হলো পাহাড়ি অঞ্চলের এক ধরণের বিশেষ চাষ পদ্ধতি। এখানে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল কেটে, তারপর সেই জায়গাটা পুড়িয়ে দিয়ে চাষ করা হয়। পোড়া ছাই সার হিসেবে কাজ করে। সাধারণত, এই পদ্ধতিতে ধান, ভুট্টা, সবজি ইত্যাদি চাষ করা হয়ে থাকে। জুম চাষকে স্থানান্তরিত কৃষিও বলা হয়, কারণ একই জমিতে কয়েক বছর চাষ করার পর উর্বরতা কমে গেলে চাষিরা নতুন জমি তৈরি করে নেয়।
জুম চাষের ইতিহাস
জুম চাষ কিন্তু আজকের কোনো নতুন পদ্ধতি নয়। এর ইতিহাস বেশ পুরনো। মনে করা হয়, প্রায় ১০,০০০ বছর আগে এর শুরু। আমাদের দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে এই চাষ অনেক আগে থেকে প্রচলিত। মূলত, জীবন ধারণের জন্য মানুষ এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল।
জুম চাষের পদ্ধতি
জুম চাষ কিভাবে করা হয়, সেটা ধাপে ধাপে জেনে নেয়া যাক:
-
জঙ্গল কাটা: প্রথমে পাহাড়ের ঢালের জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়। সাধারণত, শীতকালে এই কাজটা করা হয়।
-
শুকানো: জঙ্গল কাটার পর কিছু দিন সেগুলো শুকাতে দেওয়া হয়।
-
আগুন লাগানো: এরপর সেই শুকনো জঙ্গলগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে পোড়া ছাই মাটির সাথে মিশে গিয়ে প্রাকৃতিক সারের কাজ করে।
-
বীজ বপন: এরপর জমিতে বীজ বোনা হয়। এখানে সাধারণত ধান, ভুট্টা, মারফা, কুমড়া, তুলা, আদা, হলুদ এবং বিভিন্ন সবজির বীজ একসাথে বোনা হয়।
-
পরিচর্যা: বীজ বোনার পর নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হয় এবং অন্যান্য পরিচর্যা করতে হয়।
-
ফসল তোলা: সবশেষে, যখন ফসল পেকে যায়, তখন তা সংগ্রহ করা হয়।
জুম চাষের সুবিধা
জুম চাষের কিছু সুবিধা রয়েছে, যা এই পদ্ধতিকে এখনও টিকিয়ে রেখেছে:
- সহজ পদ্ধতি: এটা বেশ সহজ একটা পদ্ধতি। তেমন কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তির প্রয়োজন হয় না।
- প্রাকৃতিক সার: পোড়া ছাই ব্যবহার করার কারণে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না।
- মিশ্র চাষ: একই জমিতে অনেক ধরনের ফসল একসাথে চাষ করা যায়, যা খাদ্যের যোগান বাড়ায়।
- জীবনযাত্রা: পার্বত্য অঞ্চলের অনেক মানুষের জীবনযাত্রা এই চাষের উপরে নির্ভরশীল।
জুম চাষের অসুবিধা
কিছু অসুবিধা থাকার কারণে জুম চাষ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর:
- বন উজাড়: জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করার কারণে বনভূমি ধ্বংস হয়।
- মাটি ক্ষয়: পাহাড়ের মাটি আলগা হয়ে যায় এবং বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে যায়, যা ভূমিধসের কারণ হতে পারে।
- পরিবেশ দূষণ: জঙ্গল পোড়ানোর কারণে বাতাস দূষিত হয় এবং জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়।
- উর্বরতা হ্রাস: একই জমিতে বারবার চাষ করার কারণে মাটির উর্বরতা কমে যায়।
জুম চাষ কোথায় হয়?
জুম চাষ মূলত পাহাড়ি অঞ্চলে হয়ে থাকে। আমাদের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) অঞ্চলে এই চাষ বেশি দেখা যায়। এছাড়াও, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মায়ানমার, থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়ার কিছু অংশেও এই চাষ প্রচলিত আছে।
বাংলাদেশে জুম চাষ
বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে জুম চাষ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানে বিভিন্ন উপজাতি, যেমন – চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, বম, তাদের সংস্কৃতির একটা অংশ এই জুম চাষ।
অন্যান্য দেশে জুম চাষ
ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতেও জুম চাষ করা হয়। তবে, পরিবেশের উপর এর বিরূপ প্রভাবের কারণে অনেক দেশেই এখন এই চাষ নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
জুম চাষের বিকল্প পদ্ধতি
জুম চাষের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে কিছু বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে:
- সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা: পশু পালন এবং মাছ চাষের সাথে সমন্বিত করে চাষাবাদ করা।
- সার ব্যবহার: জৈব সার এবং সবুজ সার ব্যবহার করে মাটির উর্বরতা বাড়ানো।
- ফসল পর্যায়: বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করে মাটির উর্বরতা ধরে রাখা।
- বৃক্ষরোপণ: পাহাড়ের ঢালে গাছ লাগিয়ে মাটি ক্ষয় রোধ করা।
কৃষি বিজ্ঞানীদের মতামত
কৃষি বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জুম চাষের পরিবর্তে পরিবেশ-বান্ধব এবং টেকসই চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। তারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির উর্বরতা বাড়ানো এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
জুম চাষের ভবিষ্যৎ
জুম চাষের ভবিষ্যৎ এখন একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে, এটা অনেক মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস, অন্যদিকে পরিবেশের জন্য এটা ক্ষতিকর। তাই, এর একটা টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা দরকার।
টেকসই সমাধান
জুম চাষকে কিভাবে পরিবেশ-বান্ধব করা যায়, তার কিছু উপায় নিচে দেওয়া হলো:
- সঠিক পরিকল্পনা: জমি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে বনভূমি কম নষ্ট হয়।
- প্রশিক্ষণ: চাষিদের আধুনিক এবং পরিবেশ-বান্ধব চাষ পদ্ধতির উপর প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- সহায়তা: সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা থেকে চাষিদের আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে।
- সচেতনতা: জুম চাষের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
জুম চাষ নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (Frequently Asked Questions – FAQs)
জুম চাষ নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক প্রশ্ন থাকে। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
জুম চাষের প্রধান ফসল কি কি? (What are the main crops of Jhum cultivation?)
জুম চাষে অনেক ধরনের ফসল একসাথে চাষ করা হয়। এর মধ্যে প্রধান ফসলগুলো হলো ধান, ভুট্টা, মারফা, কুমড়া, তুলা, আদা, হলুদ এবং বিভিন্ন ধরনের সবজি।
জুম চাষ কি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর? (Is Jhum cultivation harmful to the environment?)
হ্যাঁ, জুম চাষ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। জঙ্গল কাটা, মাটি ক্ষয় এবং দূষণের কারণে পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়।
জুম চাষ কিভাবে মাটি ক্ষয় করে? (How does Jhum cultivation cause soil erosion?)
জুম চাষের জন্য পাহাড়ের ঢালের জঙ্গল কেটে ফেলা হয়। এর ফলে বৃষ্টির সময় মাটি আলগা হয়ে ধুয়ে যায়, যা মাটি ক্ষয়ের প্রধান কারণ।
জুম চাষের বিকল্প কি কি হতে পারে? (What are the alternatives to Jhum cultivation?)
জুম চাষের বিকল্প হিসেবে সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা, জৈব সার ব্যবহার, ফসল পর্যায় এবং বৃক্ষরোপণ করা যেতে পারে।
জুম চাষের উপকারিতা কি? (What are the benefits of Jhum cultivation?)
জুম চাষের প্রধান উপকারিতা হলো এটা সহজ পদ্ধতি এবং প্রাকৃতিক সার ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, একই জমিতে অনেক ধরনের ফসল চাষ করা যায়।
জুম চাষ কিভাবে করা হয়? (How is Jhum cultivation done?)
জুম চাষ করার জন্য প্রথমে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়। তারপর সেই জায়গাটা পুড়িয়ে দিয়ে বীজ বোনা হয়। পোড়া ছাই সার হিসেবে কাজ করে।
জুম চাষের ফলে কি ভূমিধস হয়? (Does Jhum cultivation cause landslides?)
জুম চাষের কারণে মাটি ক্ষয় হয়, যা ভূমিধসের অন্যতম কারণ।
জুম চাষের ভবিষ্যৎ কি? (What is the future of Jhum cultivation?)
জুম চাষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে পরিবেশ-বান্ধব পদ্ধতি adoption এর উপর। টেকসই সমাধান খুঁজে বের করে এই চাষকে পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর করতে হবে।
জুম চাষের জন্য উপযুক্ত মাটি কোনটি? (Which soil is suitable for Jhum cultivation?)
জুম চাষের জন্য তেমন কোনো নির্দিষ্ট মাটির প্রয়োজন হয় না। পাহাড়ের ঢালের মাটি সাধারণত বেলে-দোআঁশ হয়ে থাকে, যা এই চাষের জন্য উপযুক্ত।
আমি আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি থেকে আপনি জুম চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। যদি আপনার আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।
উপসংহার
জুম চাষ নিঃসন্দেহে আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে, পরিবেশের কথা ভেবে এর বিকল্প এবং টেকসই পদ্ধতি খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি। আসুন, আমরা সবাই মিলে পরিবেশ-বান্ধব কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলি এবং আমাদের পাহাড়কে রক্ষা করি। আপনিও আপনার মতামত জানান এবং এই আলোচনাকে আরও সমৃদ্ধ করুন।