শুনতে একটু অলস লাগলেও, নিষ্ক্রিয় মৌল কিন্তু রসায়নের জগতে বেশ কাজের জিনিস! আপনি যদি রসায়ন ভালোবাসেন বা বিজ্ঞান নিয়ে একটু আধটু ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাহলে “নিষ্ক্রিয় মৌল কাকে বলে” – এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই আপনারও মাথায় এসেছে। চলুন, আজকে আমরা এই মজার বিষয়টা নিয়ে একটু সহজভাবে আলোচনা করি।
নিষ্ক্রিয় মৌল: অলস হলেও কাজের কাজী!
নিষ্ক্রিয় মৌল, যাদেরকে আমরা noble gas বা বিরল গ্যাস নামেও চিনি, তারাPeriod টেবিলে XVIII নম্বর গ্রুপে থাকে। এদেরকে নিষ্ক্রিয় বলার কারণ হল এরা সাধারণত অন্য কোনো মৌলের সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে না। মানে, এরা নিজেদের মতো থাকতে ভালোবাসে, সহজে কারো সাথে মেশে না! কেন মেশে না, সেই গল্পেও আসছি।
নিষ্ক্রিয় মৌল কারা?
ছয়টি গ্যাসীয় মৌল এই দলের সদস্য। তাদের নামগুলো হলো:
- হিলিয়াম (He)
- নিয়ন (Ne)
- আর্গন (Ar)
- ক্রিপ্টন (Kr)
- জেনন (Xe)
- রেডন (Rn)
এদের মধ্যে রেডন তেজস্ক্রিয়।
কেন এরা নিষ্ক্রিয়? অষ্টক পূরণের খেল!
নিষ্ক্রিয় হওয়ার মূল কারণ হলো এদের বাইরের কক্ষপথে আটটি ইলেকট্রন (হিলিয়ামের ক্ষেত্রে দুইটি) বিদ্যমান। এই আটটি ইলেকট্রন থাকার কারণে এদের “অষ্টক” (Octet) পূরণ থাকে। রসায়নের ভাষায়, পরমাণুগুলো স্থিতিশীল থাকার জন্য সাধারণত ইলেকট্রন আদান-প্রদান বা শেয়ার করে নিজেদের বাইরের কক্ষপথের অষ্টক পূরণ করতে চায়। যেহেতু এই মৌলগুলোর অষ্টক আগে থেকেই পূরণ করা আছে, তাই তারা আর অন্য কারো সাথে বিক্রিয়া করতে আগ্রহী হয় না। অনেকটা আপনার যদি ভরপেট খাওয়া থাকে, তাহলে যেমন আপনি আর কিছু খেতে চান না, তেমনই!
অষ্টক নিয়মটা আসলে কী?
অষ্টক নিয়ম (Octet Rule) অনুসারে, পরমাণুগুলো তাদের সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরে আটটি ইলেকট্রন অর্জন করতে চায়, যাতে তারা স্থিতিশীল হতে পারে। এই স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য তারা ইলেকট্রন আদান-প্রদান অথবা শেয়ার করে।
কোথায় এদের দেখা মেলে?
নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো সাধারণত প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। এদের কিছু ব্যবহার নিচে দেওয়া হলো:
- হিলিয়াম: এটি বেলুন ফোলাতে, উড়োজাহাজের টায়ারে এবং MRI মেশিনে ব্যবহার করা হয়। এটি বাতাসের চেয়ে হালকা।
- নিয়ন: বিভিন্ন ধরনের আলো তৈরি করার কাজে নিয়ন গ্যাস ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে বিজ্ঞাপনী সাইনবোর্ডগুলোতে এর ব্যবহার দেখা যায়।
- আর্গন: এটি ওয়েল্ডিংয়ের কাজে এবং সাধারণ বৈদ্যুতিক বাল্বের ভিতরে ব্যবহার করা হয়।
- ক্রিপ্টন: এটি ফটোগ্রাফিক ফ্ল্যাশ বাল্বে ব্যবহৃত হয়।
- জেনন: এটি বিশেষ ধরনের বাতিতে (যেমন, প্রজেক্টর বাতিতে) এবং অ্যানেস্থেশিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- রেডন: ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডনের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়।
নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্য
নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
- এরা বর্ণহীন, গন্ধহীন এবং স্বাদহীন গ্যাস।
- এরা রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয়।
- এদের গলনাঙ্ক (melting point) এবং স্ফুটনাঙ্ক (boiling point) খুবই কম।
- এরা তাপ এবং বিদ্যুতের অপরিবাহী।
বৈশিষ্ট্য | হিলিয়াম | নিয়ন | আর্গন | ক্রিপ্টন | জেনন | রেডন |
---|---|---|---|---|---|---|
পারমাণবিক সংখ্যা | 2 | 10 | 18 | 36 | 54 | 86 |
গলনাঙ্ক (K) | N/A | 24.5 | 83.8 | 115.8 | 161.4 | 202 |
স্ফুটনাঙ্ক (K) | 4.2 | 27.1 | 87.3 | 119.9 | 165.1 | 211.4 |
এই টেবিলে, N/A মানে হলো হিলিয়াম স্বাভাবিক চাপে তরল অবস্থায় থাকে না, তাই এর গলনাঙ্ক নেই।
নিষ্ক্রিয় গ্যাস নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- হিলিয়াম গ্যাস এতটাই হালকা যে এটা দিয়ে বেলুন ফোলালে তা আকাশে উড়তে শুরু করে। শুধু তাই নয়, হিলিয়াম গ্যাস যদি কেউ নিঃশ্বাসের সাথে নেয়, তাহলে তার গলার স্বর অনেকটা হাঁসের মতো শোনাবে! (তবে এটা করা উচিত না, কারণ এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে)।
- আর্গন গ্যাস আমাদের চারপাশের বাতাসের প্রায় ১%।
- জেনন গ্যাসকে মাঝে মাঝে “স্ট্রেঞ্জার গ্যাস”ও বলা হয়, কারণ এটি খুব কম পরিমাণে যৌগ তৈরি করে।
- রেডন গ্যাস তেজস্ক্রিয় এবং এটি মাটি থেকে নির্গত হয়। তাই, আপনার বাড়ির বেজমেন্টে রেডনের মাত্রা পরীক্ষা করানো উচিত।
দৈনন্দিন জীবনে নিষ্ক্রিয় গ্যাস
নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানাভাবে ব্যবহৃত হয়। এদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার নিচে উল্লেখ করা হলো:
- আলো তৈরি: নিয়ন গ্যাস ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের রঙিন আলো তৈরি করা হয়, যা বিজ্ঞাপনী সাইনবোর্ড এবং আলোকসজ্জার কাজে ব্যবহৃত হয়।
- ওয়েল্ডিং: আর্গন গ্যাস ওয়েল্ডিং করার সময় ধাতুগুলোকে বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া থেকে রক্ষা করে, ফলে জোড়াগুলো আরও মজবুত হয়।
- চিকিৎসা: হিলিয়াম গ্যাস MRI মেশিনে শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়, যা শরীরের অভ্যন্তরীণ ছবি পেতে সাহায্য করে। জেনন গ্যাস অ্যানেস্থেশিয়া হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
- গবেষণা: নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নে।
- সুরক্ষা: হিলিয়াম গ্যাস ডুবুরিদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন ট্যাঙ্কে মেশানো হয়।
কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর (FAQ)
নিষ্ক্রিয় মৌল নিয়ে আপনাদের মনে আরও কিছু প্রশ্ন জাগতে পারে। তাই, কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:
-
নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো কি সত্যিই কোনো যৌগ গঠন করে না?
আগে ধারণা করা হতো, নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো কোনো যৌগ গঠন করে না। তবে, বিজ্ঞানীরা এখন বেশ কিছু নিষ্ক্রিয় গ্যাসের যৌগ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, বিশেষ করে ক্রিপ্টন, জেনন এবং রেডনের।
-
নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো কিভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল?
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিভিন্ন বিজ্ঞানী এই গ্যাসগুলো আবিষ্কার করেন। লর্ড র Rayleigh এবং উইলিয়াম র্যামজে আর্গন গ্যাস আবিষ্কারের জন্য ১৯০৪ সালে নোবেল পুরস্কার পান।
-
নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোর নামকরণ কিভাবে করা হয়েছে?
নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোর নামকরণ তাদের বৈশিষ্ট্য এবং উৎস অনুসারে করা হয়েছে। যেমন, হিলিয়াম নামটি এসেছে গ্রিক শব্দ “helios” থেকে, যার অর্থ “সূর্য”। কারণ, সূর্যের আলোতে প্রথম এই গ্যাসটি আবিষ্কৃত হয়েছিল।
-
নিষ্ক্রিয় গ্যাস কি দাহ্য?
না, নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো দাহ্য নয়। এরা বরং অন্য পদার্থকে জ্বলতে বাধা দেয়। এই কারণেই আর্গন গ্যাস ওয়েল্ডিং করার সময় ব্যবহার করা হয়, যাতে আগুনের ফুলকি না ছড়ায়।
নিষ্ক্রিয় মৌল এবং পর্যায় সারণী
পর্যায় সারণীতে নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোর অবস্থান XVIII নম্বর গ্রুপে। এই গ্রুপের মৌলগুলোর সর্ববহিঃস্থ স্তরে আটটি ইলেকট্রন থাকায় (হিলিয়াম ছাড়া, যার দুটি ইলেকট্রন থাকে), এরা রাসায়নিকভাবে স্থিতিশীল এবং সহজে অন্য মৌলের সাথে বিক্রিয়া করে না।
শেষ কথা
নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো হয়তো অলস, কিন্তু তারা আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আলো জ্বালানো থেকে শুরু করে জটিল চিকিৎসা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা পর্যন্ত, এদের অবদান অনস্বীকার্য। “নিষ্ক্রিয় মৌল কাকে বলে” – এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মাধ্যমে আমরা রসায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক জানতে পারলাম।
তাহলে, কেমন লাগলো আজকের আলোচনা? রসায়নের এরকম আরও মজার বিষয় নিয়ে জানতে চান? কমেন্ট করে জানান, আর বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!