আসুন, পর্বতের চূড়ায় উঠি! পর্বত কী, কেন তৈরি হয় এবং এর গুরুত্ব
ধরুন, আপনি বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দর এক জায়গায় ঘুরতে গিয়েছেন। হঠাৎ দেখলেন, দিগন্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল কিছু। সেগুলোই পর্বত। কিন্তু পর্বত আসলে কী? কেন এগুলো এত উঁচু হয়? আর আমাদের জীবনেই বা এর কী প্রয়োজন? চলুন, আজ আমরা পর্বতের সবকিছু জেনে আসি।
পর্বত কাকে বলে?
সহজ ভাষায়, পর্বত হলো পৃথিবীর বুকে প্রাকৃতিকভাবে উঁচু হয়ে থাকা বিশাল ভূখণ্ড। সাধারণত, এর চূড়া থাকে এবং চারপাশের ভূমি থেকে এটি অনেক বেশি উঁচু হয়। একটা টিলার সঙ্গে পর্বতের মূল পার্থক্য হলো এর উচ্চতা ও ঢাল। পর্বতগুলো সাধারণত কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে।
পর্বতের গঠন প্রক্রিয়া
পর্বত একদিনে তৈরি হয় না। এটি একটি দীর্ঘ এবং জটিল প্রক্রিয়া। প্রধানত তিনটি কারণে পর্বত গঠিত হতে পারে:
ভূ-আলোড়ন (Tectonic Movement):
ভূ-আলোড়ন হলো পৃথিবীর অভ্যন্তরের প্লেটগুলোর নড়াচড়া। যখন দুটি প্লেট একে অপরের দিকে ধাক্কা দেয়, তখন তাদের মাঝে থাকা ভূমি উপরের দিকে উঠে গিয়ে পর্বত তৈরি করে। হিমালয় পর্বতমালা এভাবেই তৈরি হয়েছে। দুটি বিশাল প্লেটের সংঘর্ষের ফলে এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশ্রেণী হিসেবে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবুন তো, কতো শক্তিশালী সেই ধাক্কা!
আগ্নেয়গিরি (Volcanism):
ভূগর্ভের গলিত ম্যাগমা যখন ভূপৃষ্ঠের দুর্বল স্থান দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং জমাট বাঁধে, তখন আগ্নেয়গিরি তৈরি হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে এটি পর্বতের আকার নেয়। মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো একটি আগ্নেয়গিরি পর্বত।
ক্ষয়ীভবন (Erosion):
বৃষ্টি, বাতাস এবং বরফের কারণে ধীরে ধীরে ভূমি ক্ষয় হয়ে গেলেও কিছু অংশ টিকে থাকে এবং পর্বতের রূপ নেয়। এক্ষেত্রে, নরম মাটি সরে গিয়ে শক্ত পাথরগুলো দাঁড়িয়ে থাকে।
বিভিন্ন প্রকার পর্বত
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের পর্বত দেখা যায়। এদের গঠন এবং উৎপত্তির কারণ ভিন্ন ভিন্ন। কয়েকটি প্রধান প্রকারভেদ নিচে আলোচনা করা হলো:
ভঙ্গিল পর্বত (Fold Mountains):
এই পর্বতগুলো ভূ-আলোড়নের ফলে সৃষ্টি হয়। যখন দুটি প্লেট একে অপরের দিকে ধাক্কা দেয়, তখন তাদের মাঝে থাকা শিলাস্তর ভাঁজ হয়ে উপরের দিকে ওঠে এবং ভঙ্গিল পর্বত তৈরি করে।
উদাহরণ:
- হিমালয় পর্বতমালা (Himalayan Mountains)
- আল্পস পর্বতমালা (Alps Mountains)
- আন্দিজ পর্বতমালা (Andes Mountains)
স্তূপ পর্বত (Block Mountains):
ভূত্বকের ফাটলের কারণে যখন কোনো একটি অংশ উপরে উঠে যায় বা নিচের দিকে নেমে যায়, তখন স্তূপ পর্বত গঠিত হয়।
উদাহরণ:
- জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট (Black Forest)
- ফ্রান্সের ভোজেস পর্বত (Vosges Mountains)
আগ্নেয় পর্বত (Volcanic Mountains):
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে লাভা ও অন্যান্য উপাদান জমা হয়ে এই পর্বত তৈরি হয়।
উদাহরণ:
- মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো (Mount Kilimanjaro)
- মাউন্ট ফুজি (Mount Fuji)
- মাউন্ট ভিসুভিয়াস (Mount Vesuvius)
ক্ষয়জাত পর্বত (Residual Mountains):
বৃষ্টি, বাতাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে প্রাচীন পর্বতমালা ক্ষয়ে গিয়ে অবশিষ্ট অংশগুলো ক্ষয়জাত পর্বত হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে।
উদাহরণ:
- ভারতের আরাবল্লী পর্বত (Aravalli Range)
- যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানাতে অবস্থিত বিটাররুট রেঞ্জ (Bitterroot Range)
পর্বতের গুরুত্ব
পর্বত শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, আমাদের জীবনে এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
নদীর উৎস (Source of Rivers):
বেশিরভাগ নদীর উৎস হলো পর্বত। পর্বতের বরফ গলা পানি থেকেই নদীগুলো সৃষ্টি হয়, যা আমাদের জীবন এবং কৃষিকাজের জন্য অপরিহার্য।
বৃষ্টিপাত (Rainfall):
পর্বতমালা বায়ুপ্রবাহকে বাধা দিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে। এর ফলে উর্বর ভূমি সৃষ্টি হয় এবং কৃষিকাজ ভালো হয়।
জীববৈচিত্র্য (Biodiversity):
পর্বতে বিভিন্ন प्रकारের উদ্ভিদ ও প্রাণী বাস করে। এটি জীববৈচিত্র্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
পর্যটন (Tourism):
পর্বত পর্যটকদের কাছে খুব জনপ্রিয়। ট্রেকিং, মাউন্টেনিয়ারিং এবং স্কিইংয়ের জন্য বহু মানুষ এখানে আসেন, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে সাহায্য করে।
খনিজ সম্পদ (Mineral Resources):
পর্বতের নিচে অনেক মূল্যবান খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়, যা আমাদের শিল্প এবং অর্থনীতির জন্য খুবই দরকারি।
বাংলাদেশের পাহাড় ও পর্বত
অনেকেই হয়তো জানেন না, বাংলাদেশেও কিছু ছোট পাহাড় ও পর্বত আছে। এগুলো সাধারণত টারশিয়ারি যুগের পাহাড় নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের প্রধান পাহাড় ও পর্বতগুলো:
- কেওক্রাডং (Keokradong): এটি বাংলাদেশের অন্যতম উচ্চ পর্বতশৃঙ্গ।
- তাজিংডং (Tazingdong): এটিও খুব পরিচিত এবং অনেক পর্যটকের কাছে প্রিয় একটি জায়গা।
- চিম্বুক পাহাড় (Chimbuk Hill): এটি বান্দরবানে অবস্থিত এবং পর্যটকদের কাছে খুব জনপ্রিয়।
এই পাহাড়গুলো আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং এখানে অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে।
পর্বত নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- হিমালয় পর্বতমালা প্রতি বছর প্রায় ১ সেন্টিমিটার করে বাড়ছে! কারণ, ইন্ডিয়ান এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের মধ্যে এখনো ধাক্কা চলছে।
- মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় প্রথম মানুষ গিয়েছিলেন ১৯৫৩ সালে। এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে নামের দুই পর্বতারোহী এই কৃতিত্ব অর্জন করেন।
- কিছু পর্বত সমুদ্রের নিচেও রয়েছে। এদেরকে সমুদ্র পর্বত বলা হয়।
পর্বত বিষয়ক কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
এখানে পর্বত নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তার উত্তর দেওয়া হলো:
পর্বত এবং পাহাড়ের মধ্যে পার্থক্য কী?
উচ্চতার ভিত্তিতে পর্বত ও পাহাড়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। সাধারণত, ৬০০ মিটারের বেশি উচ্চতাকে পর্বত এবং এর কম উচ্চতাকে পাহাড় বলা হয়। তবে, এটা একটা সাধারণ ধারণা, অঞ্চলের ওপর ভিত্তি করে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়।
পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতমালা কোনটি?
পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতমালা হলো আন্দিজ পর্বতমালা। এটি প্রায় ৭,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে বিস্তৃত।
সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্বত কোনটি?
কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতকে পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক পর্বত হিসেবে গণ্য করা হয়। এর খাড়া ঢাল এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এটি আরোহণ করা খুব কঠিন।
পর্বতে কী ধরনের বিপদ হতে পারে?
পর্বতে আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন, ভূমিধস, তুষারধস, অক্সিজেন স্বল্পতা এবং উচ্চতাজনিত অসুস্থতা সহ নানা ধরনের বিপদ হতে পারে। তাই পর্বতারোহণের সময় অভিজ্ঞ গাইড এবং সঠিক সরঞ্জাম সাথে রাখা উচিত।
পর্বত কীভাবে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে?
পর্বতমালা বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে, নদীর উৎস তৈরি করে এবং বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
“পর্বত” শব্দটির উৎপত্তি কোথা থেকে?
“পর্বত” শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। সংস্কৃতে এর অর্থ হলো “পাথর” বা “শিলার স্তূপ”।
পর্বত আরোহণের প্রস্তুতি
যদি আপনি কখনো পর্বত আরোহণ করতে চান, তাহলে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।
- শারীরিক প্রস্তুতি: নিয়মিত ব্যায়াম এবং দৌড়ের মাধ্যমে নিজের শরীরকে প্রস্তুত করুন।
- মানসিক প্রস্তুতি: প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখার মানসিক প্রস্তুতি নিন।
- সরঞ্জাম: ভালো মানের ট্রেকিং বুট, গরম কাপড়, গ্লাভস, টুপি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সাথে নিন।
- অভিজ্ঞ গাইড: একজন অভিজ্ঞ গাইডের সাহায্য নিন, যিনি পথঘাট সম্পর্কে ভালো জানেন।
উপসংহার
পর্বত আমাদের প্রকৃতির এক अद्भुत সৃষ্টি। এর সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধ করার মতো, তেমনি এর গুরুত্বও অনেক। পর্বতমালা আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং জীবনে নানাভাবে অবদান রাখে। তাই, পর্বতের প্রতি আমাদের যত্নশীল হওয়া উচিত। আমরা যদি আমাদের চারপাশের প্রকৃতির প্রতি মনোযোগী হই, তাহলে জীবন আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। কেমন লাগলো আজকের এই পর্বতের গল্প? আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।