আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? আজ আমরা কথা বলব পরিবাহিতা নিয়ে। পদার্থবিজ্ঞান অনেকের কাছে একটু কঠিন লাগতে পারে, কিন্তু আমি চেষ্টা করব সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিতে। পরিবাহিতা এমন একটা জিনিস যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক কাজে লাগে, কিন্তু আমরা হয়তো সেভাবে খেয়াল করি না। চলুন, তাহলে শুরু করা যাক!
পরিবাহিতা: বিদ্যুৎ চলাচলের সহজ পথ!
পরিবাহিতা (Conductivity) হলো কোনো পদার্থের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ বা তাপ কত সহজে প্রবাহিত হতে পারে তার পরিমাপ। সহজ ভাষায়, কোনো বস্তু কত সহজে বিদ্যুৎ বা তাপ পরিবহন করতে পারে, সেটাই হলো তার পরিবাহিতা। এটা অনেকটা একটা রাস্তার মতো, রাস্তা যত মসৃণ হবে, গাড়ি তত সহজে চলতে পারবে। তেমনি কোনো পদার্থের পরিবাহিতা যত বেশি, তার মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ বা তাপ তত সহজে যেতে পারবে।
পরিবাহিতা কী?
“পরিবাহিতা কাকে বলে?” – এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, এটা হলো কোনো পদার্থের “বিদ্যুৎ পরিবহন করার ক্ষমতা”। প্রত্যেক পদার্থের নিজস্ব পরিবাহিতা আছে। কিছু পদার্থ খুব ভালো পরিবাহী, যেমন – তামা (Copper) বা রুপা (Silver)। আবার কিছু পদার্থ বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে না, যেমন – কাঠ বা প্লাস্টিক। এদেরকে আমরা অন্তরক (Insulator) বলি।
পরিবাহিতার সংজ্ঞা (Definition of Conductivity)
- বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা (Electrical Conductivity): কোনো পদার্থের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহের আপেক্ষিক ক্ষমতাকে বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা বলে। এর একক হলো সিমেন্স প্রতি মিটার (Siemens per meter, S/m).
- তাপ পরিবাহিতা (Thermal Conductivity): কোনো পদার্থের মধ্য দিয়ে তাপ প্রবাহের আপেক্ষিক ক্ষমতাকে তাপ পরিবাহিতা বলে। এর একক হলো ওয়াট প্রতি মিটার কেলভিন (Watt per meter Kelvin, W/(m·K)).
পরিবাহিতা কিভাবে কাজ করে?
পরিবাহিতার মূল বিষয়টি বুঝতে হলে, পদার্থের ভেতরের ইলেকট্রনগুলোর আচরণ জানা দরকার।
- ধাতু (Metals): ধাতুর মধ্যে অনেক মুক্ত ইলেকট্রন (Free electrons) থাকে। যখন ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয়, তখন এই ইলেকট্রনগুলো সহজেই চলাচল করতে পারে এবং বিদ্যুৎ পরিবহন করে।
- অন্তরক (Insulators): অন্তরকের মধ্যে তেমন কোনো মুক্ত ইলেকট্রন থাকে না। তাই তারা বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে না।
- অর্ধপরিবাহী (Semiconductors): অর্ধপরিবাহী হলো সেই পদার্থ, যারা সাধারণ অবস্থায় অন্তরকের মতো আচরণ করে, কিন্তু বিশেষ অবস্থায় পরিবাহীর মতো কাজ করতে পারে। যেমন – সিলিকন (Silicon) এবং জার্মেনিয়াম (Germanium)।
বিভিন্ন প্রকার পরিবাহিতা
পরিবাহিতা শুধুমাত্র বিদ্যুতের ক্ষেত্রেই নয়, তাপের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই, পরিবাহিতাকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়:
বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা (Electrical Conductivity)
বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা হলো কোনো পদার্থের বিদ্যুৎ পরিবহন করার ক্ষমতা। যে পদার্থের বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা যত বেশি, সেটি তত ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী।
বৈদ্যুতিক পরিবাহিতার উদাহরণ
- তামা (Copper): তামার বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা অনেক বেশি। তাই এটি তার (Wire) তৈরির জন্য খুবই উপযোগী। আমাদের বাসা-বাড়িতে যে তার ব্যবহার করা হয়, তার বেশিরভাগই তামা দিয়ে তৈরি।
- সোনা (Gold): সোনার পরিবাহিতা অনেক বেশি এবং এটি ক্ষয় হয় না। তাই এটি ইলেকট্রনিক্স এর বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়।
- রূপা (Silver): রূপার পরিবাহিতা সবচেয়ে বেশি, কিন্তু এটি অনেক মূল্যবান হওয়ায় সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় না।
তাপ পরিবাহিতা (Thermal Conductivity)
তাপ পরিবাহিতা হলো কোনো পদার্থের তাপ পরিবহন করার ক্ষমতা। যে পদার্থের তাপ পরিবাহিতা যত বেশি, সেটি তত ভালো তাপ পরিবাহী।
তাপ পরিবাহিতার উদাহরণ
- অ্যালুমিনিয়াম (Aluminium): অ্যালুমিনিয়ামের তাপ পরিবাহিতা ভালো। এটি রান্নার পাত্র এবং হিট সিঙ্ক (Heat sink) তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
- লোহা (Iron): লোহার তাপ পরিবাহিতা মাঝারি মানের। এটি হিটিং সিস্টেম এবং ইঞ্জিন তৈরিতে কাজে লাগে।
- হীরা (Diamond): হীরার তাপ পরিবাহিতা অনেক বেশি। এটি কিছু বিশেষ ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে ব্যবহার করা হয়।
পরিবাহিতার একক (Units of Conductivity)
পরিবাহিতার একক জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। এটি আমাদের পরিমাপ করতে সাহায্য করে।
বৈদ্যুতিক পরিবাহিতার একক
বৈদ্যুতিক পরিবাহিতার একক হলো সিমেন্স প্রতি মিটার (Siemens per meter, S/m)। একে অনেক সময় mho/m হিসাবেও লেখা হয়।
তাপ পরিবাহিতার একক
তাপ পরিবাহিতার একক হলো ওয়াট প্রতি মিটার কেলভিন (Watt per meter Kelvin, W/(m·K)).
পরিবাহিতাকে প্রভাবিত করার কারণসমূহ
কিছু বিষয় আছে যা পরিবাহিতার উপর প্রভাব ফেলে। নিচে কয়েকটি কারণ আলোচনা করা হলো:
তাপমাত্রা (Temperature)
সাধারণত, তাপমাত্রা বাড়লে ধাতুর পরিবাহিতা কমে যায়। কারণ, তাপমাত্রা বাড়লে ধাতুর মধ্যে থাকা পরমাণুগুলোর কম্পন বাড়ে, যা ইলেকট্রনের চলাচলে বাধা দেয়।
উপাদান (Material)
বিভিন্ন পদার্থের পরিবাহিতা বিভিন্ন হয়। যেমন, তামার পরিবাহিতা অ্যালুমিনিয়াম থেকে বেশি।
অশুচিতা (Impurities)
কোনো পদার্থের মধ্যে যদি ভেজাল মেশানো হয়, তবে তার পরিবাহিতা কমে যেতে পারে। ভেজাল পদার্থ ইলেকট্রনের চলাচলে বাধা দেয়।
চাপ (Pressure)
চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেও পরিবাহিতা পরিবর্তন করা সম্ভব, তবে এটি খুব বেশি প্রভাব ফেলে না।
দৈনন্দিন জীবনে পরিবাহিতার ব্যবহার
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিবাহিতার অনেক ব্যবহার রয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:
বৈদ্যুতিক তার (Electrical Wires)
বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য তামা বা অ্যালুমিনিয়ামের তার ব্যবহার করা হয়। এই তারগুলো বিদ্যুৎকে সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে পারে।
ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস (Electronics Devices)
কম্পিউটার, মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে পরিবাহী পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এগুলো ডিভাইসের বিভিন্ন অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
হিটিং উপাদান (Heating Elements)
ইস্ত্রি, হিটার এবং অন্যান্য গরম করার যন্ত্রে পরিবাহী পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এগুলো বিদ্যুৎকে তাপে রূপান্তরিত করে।
সেন্সর (Sensors)
বিভিন্ন সেন্সরে পরিবাহী পদার্থ ব্যবহার করা হয়, যা পরিবেশের পরিবর্তন অনুভব করতে পারে।
অর্ধপরিবাহী: আধুনিক প্রযুক্তির মেরুদণ্ড
অর্ধপরিবাহী (Semiconductors) হলো এমন পদার্থ, যারা পরিবাহী এবং অন্তরকের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে। এদের পরিবাহিতা নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং এটি আধুনিক প্রযুক্তিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অর্ধপরিবাহী কিভাবে কাজ করে?
অর্ধপরিবাহীর পরিবাহিতা ডোপিং (Doping) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়। ডোপিং হলো অর্ধপরিবাহীর মধ্যে অন্য কোনো পরমাণু যোগ করা, যা এর ইলেকট্রনিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে।
অর্ধপরিবাহীর ব্যবহার
- ট্রানজিস্টর (Transistors): ট্রানজিস্টর হলো অর্ধপরিবাহী দিয়ে তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ ডিভাইস, যা ইলেকট্রনিক সংকেত নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা হয়।
- সোলার সেল (Solar cells): সোলার সেল অর্ধপরিবাহী ব্যবহার করে সূর্যের আলোকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে।
- LED (Light Emitting Diode): LED হলো অর্ধপরিবাহী ডায়োড, যা আলো উৎপন্ন করে।
পরিবাহিতা এবং রোধ: একে অপরের বিপরীত
পরিবাহিতা এবং রোধ (Resistance) একে অপরের বিপরীত। পরিবাহিতা হলো বিদ্যুৎ পরিবহন করার ক্ষমতা, আর রোধ হলো বিদ্যুৎ পরিবহনে বাধা দেওয়া। কোনো পদার্থের রোধ যত বেশি, তার পরিবাহিতা তত কম।
রোধের একক (Unit of Resistance)
রোধের একক হলো ওহম (Ohm), যাকে Ω চিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
পরিবাহিতা এবং রোধের সম্পর্ক
পরিবাহিতা (G) এবং রোধ (R) এর মধ্যে সম্পর্ক হলো:
G = 1/R
কিছু সাধারণ পদার্থের পরিবাহিতা তালিকা
পদার্থ | বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা (S/m) | তাপ পরিবাহিতা (W/(m·K)) |
---|---|---|
তামা (Copper) | 5.96 x 10^7 | 401 |
অ্যালুমিনিয়াম (Aluminium) | 3.77 x 10^7 | 237 |
লোহা (Iron) | 1.00 x 10^7 | 80 |
সোনা (Gold) | 4.52 x 10^7 | 317 |
রূপা (Silver) | 6.30 x 10^7 | 429 |
কাঠ (Wood) | 10^-8 – 10^-14 | 0.04 – 0.4 |
কাচ (Glass) | 10^-10 – 10^-14 | 1.05 |
এই তালিকা থেকে আমরা বিভিন্ন পদার্থের পরিবাহিতা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি।
“পরিবাহিতা কাকে বলে” নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তাদের উত্তর দেওয়া হলো, যা পরিবাহিতা সম্পর্কে আপনার ধারণা আরও স্পষ্ট করবে:
পরিবাহিতা এবং রোধের মধ্যে পার্থক্য কী?
পরিবাহিতা হলো বিদ্যুৎ বা তাপ পরিবহন করার ক্ষমতা, যেখানে রোধ হলো বিদ্যুৎ বা তাপ পরিবহনে বাধা দেওয়া। এরা একে অপরের বিপরীত।
কোন পদার্থের পরিবাহিতা সবচেয়ে বেশি?
রূপা (Silver) হলো সবচেয়ে বেশি পরিবাহী পদার্থ।
তাপমাত্রা বাড়লে পরিবাহিতার কী পরিবর্তন হয়?
সাধারণত, তাপমাত্রা বাড়লে ধাতুর পরিবাহিতা কমে যায়।
অর্ধপরিবাহী কী?
অর্ধপরিবাহী হলো সেই পদার্থ, যা সাধারণ অবস্থায় অন্তরকের মতো আচরণ করে, কিন্তু বিশেষ অবস্থায় পরিবাহীর মতো কাজ করতে পারে।
পরিবাহিতার একক কী?
বৈদ্যুতিক পরিবাহিতার একক হলো সিমেন্স প্রতি মিটার (S/m) এবং তাপ পরিবাহিতার একক হলো ওয়াট প্রতি মিটার কেলভিন (W/(m·K))।
উপসংহার
আশা করি, “পরিবাহিতা কাকে বলে” এই বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে পেরেছি। পরিবাহিতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই জ্ঞান আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগবে। যদি আপনার এই বিষয়ে আরো কিছু জানার থাকে, তবে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। ধন্যবাদ!