রচনাঃ শিষ্টাচার

আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “শিষ্টাচার“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।

শিষ্টাচার

ভূমিকা : মানবজীবনের অত্যাবশ্যক গুণাবলির অন্যতম হলো সৌজন্য ও শিষ্টাচার। দেহের সৌন্দর্য অলঙ্কার; কিন্তু আত্মার সৌন্দর্য শষ্টাচার। অলঙ্কার বাইরের সামগ্রী আর শিষ্টাচার অন্তরের এবং সৌজন্যবোধ হলো তার মার্জিত প্রকাশ। প্রাত্যহিক জীবনচর্চা ও জীবনবিকাশের ক্ষেত্রে এই গুণাবলি অপরিহার্য। চলনে-বলনে, আচরণে, পোশাক-পরিচ্ছদে এবং ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য ও চারিত্র্যিক দীপ্তি প্রকাশেও এ গুণগুলো ক্রিয়াশীল থাকে। ঘরে বাইরে সর্বত্র শিষ্ট আচরণ ও সৌজন্য না থাকলে চলে না ব্যক্তির জীবন, চলে না সমাজের জীবন। সমাজবদ্ধ জীবনে শিষ্টাচার একটি অপরিহার্য চারিত্রিক সম্পদ ব্যক্তিগত ও সামাজিক ঐশ্বর্য ।

বৈশিষ্ট্য : ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সৌজন্য ও শিষ্টাচারের মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে। প্রকৃতপক্ষে সৌজন্য, শিষ্টাচার, আদব-কায়দা তিনটিই সমার্থক। শিষ্টতা, নম্রতা, ভদ্রতা, মার্জিত এবং নীতিনিষ্ঠ ব্যবহার ইত্যাদি ব্যক্তির অন্তরের ও বাইরের আবশ্যিক উপাদান। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, শিষ্টাচার যেন অন্তরের সম্পদ, সৌজন্য বাইরের অলঙ্কার—দুটিই এনে দেয় ব্যক্তির পূর্ণতা এবং মনুষ্যত্বের গৌরব। শান্তশিষ্ট মার্জিত ব্যবহারের ওপরই গড়ে ওঠে ব্যক্তির বাইরের ভদ্র ও সৌজন্যমূলক আচরণ। প্রাত্যহিক অতিক্ষুদ্র কাজ ও আচরণে এবং বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রেও শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ বা আদব-কায়দা আবশ্যক ।

শিষ্টাচারের গুরুত্ব : মানুষের জীবনে শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ কিংবা আদব-কায়দার গুরুত্ব অপরিসীম। ছাত্রজীবন মানুষের সমগ্র জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিষ্টাচার গড়ে ওঠার প্রকৃত সময়ই হলো ছাত্রজীবন। শিক্ষার্থীদের বই-পুস্তকের পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের সাথে সাথে সদাচার সম্পর্কেও শিক্ষা অর্জন করা প্রয়োজন। কারণ পুঁথিগত বিদ্যা যেমন একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞানী হতে শেখায়, তেমনই শিষ্টাচারও তাকে সভ্য, ভদ্র ও নাগরিক জ্ঞানসম্পন্ন হতে শেখায়। বিদ্যালাভের ডিগ্রির সাথে সাথে একজন মানুষের সভ্যতার মানও বৃদ্ধি পায়। জীবনকে মধুর এবং মহৎ করার ব্যাপারে শিষ্টাচারের গুরুত্ব অনেক বেশি। অপরকে আনন্দ দিয়ে নিজে আনন্দিত হওয়া এবং অপরের কাছ থেকে সম্মান অর্জন করা এটি জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। মানুষের এ পাওয়ার পিছনে শিষ্টাচারের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। অর্থবিত্ত লাভ করাই বড় কথা নয়— মানুষের মন জয়ই বড় কথা । শিষ্টাচারের মাধ্যমেই মানুষের হৃদয় জয় করা যায়।

Read More:  রচনাঃ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সামাজিক রীতি ও শিষ্টাচার : যে সমাজ যত সভ্য, তার লোকব্যবহার তত মার্জিত, সদ্ভাবমূলক এবং সুরুচিব্যঞ্জক। সেই লোকব্যবহারকে কোথাও কোথাও আন্তরিকতাহীন, বাহ্যিক রীতিমাত্র বলে ভ্রম হয় । সামাজিক অনুষ্ঠানে সৌজন্য এবং সৌষ্ঠব রক্ষার জন্য কতকগুলো সাধারণ সর্বজনীন রীতি অনুসরণ করে চলতে হয় । ভদ্রতা বাইরের আচরণীয় রীতিমাত্র নয়। রীতি শুধু বাইরের অভ্যাসমাত্র, তাতে অন্তরের স্পর্শ থাকে না । শিষ্টাচার অন্তরের বিকশিত কুসুম, হৃদয়ের অমূল্য সম্পদ ।

মনুষ্যত্বের নিয়ন্তা : সবার আগে মানুষের সঙ্গে মানুষের সদাচরণ ও প্রীতির সম্পর্ক চাই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “আমরা মানুষ, মানুষের মধ্যে জন্মেছি। এই মানুষের সঙ্গে নানা প্রকারে মেলবার জন্যে, তাদের সঙ্গে নানাপ্রকার আবশ্যকের ও আনন্দের আদান-প্রদান চালাবার জন্য আমাদের অনেকগুলো প্রবৃত্তি আছে।” বাস্তবিকই মানুষের সঙ্গে মানুষের শিষ্ট সুন্দর সম্পর্কই বৃহত্তর সমাজ রচনা করে। পিতামাতা, ভাইবোন, পুত্রকন্যা, আত্মীয়-প্রতিবেশী ইত্যাদি নানারূপে মানুষের পরিচয়। এই পরিচয়কে সত্যসুন্দর করে প্রীতির আচরণ। শুধু তা-ই নয়, দুঃখী আর্তের প্রতি করুণা ও সেবা, সম্মানিতের প্রতি শ্রদ্ধা, নেতার প্রতি আনুগত্য, প্রতিবেশীর প্রতি সখ্যতা ইত্যাদি অজস্র দিক দিয়ে প্রত্যেকের সম্পর্কের গণ্ডিরেখা নির্মিত হয়েছে। এই আদর্শ আচরণবিধিই নিয়ন্ত্রিত জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়, যেমন ব্যাত্যাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের নৌকার হাল নৌকাকে নিয়ন্ত্রণ করে লক্ষ্যে নিয়ে যায় । কাজেই পরিবারের মধ্যে আপনজনের আত্মীয়তা না হলে পরিবারের চলে না, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও চলে না। ব্যক্তিজীবনে কঠিন অভ্যাসের মধ্য দিয়েই গড়ে তুলতে হয় এসব আন্তর বহিরাচরণ । শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ গড়া থেকেই সবাইকে সতর্ক করায়, অশিষ্ট, অন্যায়, উদ্ধত এবং ইতরোচিত ব্যবহার থেকে বিরত করায়; মিথ্যাবাদিতা, নির্লজ্জতা, রূঢ়- ভাষণ বা অপ্রিয় ভাষণ, রুচিহীন, অশালীন, উগ্র ও উত্তেজক পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান ইত্যাদি অসামাজিক উপসর্গগুলো সম্পর্কে আত্মসচেতন করায়।

শিষ্টাচার ও সৌজন্যের অভাবের ভয়াবহতা : ধনীর শোষণ উদ্ধৃত করে নির্ধনকে, শাসকের অপশাসন বিদ্রোহী করে প্রজাকে পিতামাতার দুর্ব্যবহার অভিমানাহত করে পুত্রকন্যাকে। শিক্ষক ও শিক্ষানিয়ামকদের অবিচার পথভ্রষ্ট করে ছাত্রসমাজকে। এভাবেই সমাজের মধ্যে চলেছে পারস্পরিক অনাচার, অসৌজন্যের প্রতিক্রিয়া । সামান্য ভদ্রতা, শিষ্টতা ও নৈতিকতার অভাবে সব স্তরের মানুষ ধীরে ধীরে সামাজিক সম্পর্ক হারায়। ওপর তলার সঙ্গে নিচের তলার মানুষের চরিত্রেও ঘুণ ধরে। সদাচার ও সৌজন্যের দায়বদ্ধতা না থাকলে সামান্য চক্ষুলজ্জাও থাকে না। ফলে চরমে ওঠে মিথ্যাচার, শঠতা, ধাপ্পা ও ধান্দাবাজি । ভোগবিলাস এবং অর্থলিপ্সা হয় বেপরোয়া। আজকাল সিনেমায় শিল্পসাহিত্যে নির্বোধ হিংস্রতা ও অশ্লীলতার বেসাতি। রাজনীতি নেমেছে পাপপঙ্কে। মিছিল, হৈ-হল্লা, ভাঙচুর, চুরি-ডাকাতি, নেশাভাঙ, বোমাবাজি, ঘরবাড়ি পোড়ানো, শিশু নর-নারী হত্যা ঘটে চলেছে নিরন্তর। কিশোর, যুবক- যুবতী থেকে শুরু করে সরকারি আমলা পর্যন্ত যে যার সুবিধামতো উল্টো পথে ছুটেছে। ভ্রষ্টাচার, ষড়যন্ত্র, দেশদ্রোহিতা ইত্যাদি নিত্যকার কর্মসূচি।

Read More:  রচনাঃ শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতা

শিষ্টাচারী হওয়ার উপায় : শিষ্টাচারের অধিকারী হতে হলে অন্যান্য গুণের মতোই তার চর্চা প্রয়োজন। গৃহের সুন্দর পরিবেশে মাতাপিতা, ভাইবোন ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে শিশুরা শিষ্টাচার শিক্ষালাভ করে। স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনে শিক্ষকদের কাছ থেকেও শিক্ষার সুযোগ আছে। প্রকৃতপক্ষে চারদিকের প্রভাবে পড়েই মানুষের চরিত্রের শিষ্টাচারের পরিচয় প্রকাশ পায় । কাজেই মানুষকে আশৈশব আত্মসংযম ও মার্জিত রুচির অনুশীলন করতে হয়। শান্ত গৃহকোণে, কলকাকলি মুখরিত শিক্ষায়তনে যে শিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা করা হয়েছে তার সার্থক রূপায়ণের মধ্যেই শিষ্টাচারী বা ভদ্র হওয়ার সুযোগ নিহিত। এক কথায়, শিষ্ট সুন্দর আচরণই শিষ্টাচার। দুঃখী-আর্তের প্রতি করুণা ও সেবা, সম্মানিতের প্রতি শ্রদ্ধা, নেতার প্রতি আনুগত্য, প্রতিবেশীর প্রতি সখ্যতা ও সুন্দর আচরণ প্রকাশের মাধ্যমে শিষ্টাচারী হিসেবে পরিচিত হওয়া যায় ।

উপসংহার : শিষ্টাচারের পরিচয় ফুটে ওঠে মানুষের কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। শিষ্টাচার সমাজজীবনকে উন্নত করে, পরিবেশকে সুন্দর করে, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বাড়ায়। শিষ্টাচারের বিকাশ ঘটাতে পারলে পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য স্থাপিত হতে পারে। তাই শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ বা আদব-কায়দার গুরুত্ব অপরিসীম।

 

সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করছি আমাদের এই পোস্ট থেকে রচনা যেটি তুমি চাচ্ছিলে সেটি পেয়ে গিয়েছ। যদি তুমি আমাদেরকে কোন কিছু জানতে চাও বা এই রচনা নিয়ে যদি তোমার কোনো মতামত থাকে, তাহলে সেটি আমাদের কমেন্টে জানাতে পারো। আজকের পোস্টে এই পর্যন্তই, তুমি আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করে আমাদের বাকি পোস্ট গুলো দেখতে পারো।

Fahim Raihan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *