আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা : কবিশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্তমান বিশ্বের এক বিরাট বিস্ময়। কেবল কবিশ্রেষ্ঠ হিসেবেই নয়, সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদরূপেও তিনি সারা বিশ্বে সম্মানিত। মানবজীবনের এমন কোনো চিন্তা নেই, এমন কোনো ভাব নেই, যেখানে তিনি বিচরণ করেন নি । তিনি মানুষের চিরন্তন সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার পালাগান রচনা করে গিয়েছেন। তাঁর কাব্যে ব্যথাহত পাবে ব্যথা বিজয়ের প্রেরণা, দার্শনিক পাবেন প্রকৃত সত্যের সন্ধান, রাজনীতিক পাবেন নির্ভুল পথের নির্দেশ, মৃত্যুপথযাত্রী পাবেন মৃত্যুঞ্জয়ী সান্ত্বনা। এক কথায়, এ দুঃখ-দ্বন্দ্বময়, নৈরাশ্যপীড়িত যুগে রবীন্দ্রনাথই আমাদের একমাত্র কল্পবৃক্ষ; আমরা রবীন্দ্রনাথের ভাবতরঙ্গে অবগাহন করি, তাঁর চিন্তাধারায় চিন্তা করি, তাঁর সুরে গান গাই, তাঁর ভাষায় কথা বলি ।
পরিবেশ ও আবির্ভাব : কলকাতার জোড়াসাঁকোর প্রখ্যাত ঠাকুর পরিবার ছিল উনিশ শতকের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। কাব্য কবিতা ও শিল্প সংস্কৃতি চর্চা থেকে জাতীয় জাগৃতির শুভ উদ্বোধন পর্যন্ত এই পরিবারের সার্থক অবদানের কথা সমগ্র ভারত চিরকাল সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করবে। সেই সঙ্গে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জ্যোতির্ময় ঔপনিষদিক সাধনা, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অভূতপূর্ব যোগফল এবং নবোন্মোচিত স্বাদেশিকতা এ পরিবারে যে একটি অভিনব সৃষ্টিমুখর পরিমণ্ডল রচনা করেছিল; সে পরিবেশে ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১৩৬৮) আবির্ভূত হলেন এ যুগের কবিশ্রেষ্ঠ ও মহামনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শৈশব শিক্ষা : ঠাকুর পরিবারে উন্নত শিক্ষাদীক্ষা, মার্জিত সাংস্কৃতিক চেতনা এবং পিতার অলৌকিক ধর্মবিশ্বাস সফল হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মধ্যে । তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বাল্যকালে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমী, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যাশিক্ষার জন্যে তাঁকে পাঠিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তিনি স্কুলের পাঠ শেষ করতে পারেন নি । স্কুলের প্রথাগত শিক্ষা তাঁর না হলেও বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে জ্ঞানার্জনের কোনো ত্রুটি ঘটে নি। ১৭ বছর বয়সে একবার ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তাঁকে বিলেত পাঠানো হয়। কিন্তু দেড় বছর পর তা শেষ না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। উত্তর জীবনে যিনি হবেন বিশ্বকবি, জগতের মহামনীষীদের অন্যতম, প্রচলিত কুণ্ঠিত শিক্ষাধারার সাধ্য কী তাঁর মহান চেতনাকে বেঁধে রাখে। তাই দেখা যায়, স্কুল-কলেজের কুণ্ঠিত বিদ্যায় তাঁর মন ভরে নি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যার সকল দুয়ার তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল।
কবি কিশোরের কাব্যচর্চা : এবার শুরু হলো কবি কিশোরের নিরবচ্ছিন্ন কাব্যচর্চা। তের বছর বয়সে রচিত তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায়। তারপর তাঁর কাব্যোদ্যানে শুরু হয়ে যায় কাব্য কুসুমের উৎসব। কয়েক বছর পরে পাশ্চাত্য সাহিত্য সংস্কৃতির নিবিড় পরিচয় এবং সেই সাথে পাশ্চাত্য সংগীতের সুর মূর্ছনা নিয়ে তিনি ফিরে আসেন স্বদেশে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রেরণায় এবার প্রাণে এল গানের মওসুম, রচিত হলো প্রথম গীতিনাট্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ তাঁর প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংগীতচর্চার আশ্চর্য ফসল ।
সাহিত্য সাধনা : বাংলা কাব্যের প্রথম রূপশিল্পী রবীন্দ্রনাথ। হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতিগুলোকে মানুষের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার ভাষায় তিনি রূপ দিয়েছেন। যৌবনের প্রথম প্রভাতে তাঁর কাব্যের যে উৎসমুখ খুলে গিয়েছিল, তার মর্মরিত কলতানে ঝঙ্কৃত হয়ে উঠল সন্ধ্যা সংগীত, প্রভাত সংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, মানসী ও সোনার তরী। এবার সোনার তরীর পালে লাগল সৌন্দর্যের হাওয়া। চিত্রা, চৈতালি, কণিকা, ক্ষণিকা, কল্পনা, কথা ও কাহিনী, নৈবেদ্য, খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতালি, গীতিমাল্যের সোনার ফসলে তরী হলো বোঝাই। তারপর ‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।’ বলাকা, পূরবী, পলাতক, বনবাণী, মহুয়া, পরিশেষ, পুনশ্চ, পত্রপুট, শেষসপ্তক ও শ্যামলীর ধারা বেয়ে তাঁর কাব্যতরী নবজাতক, সানাই, জন্মদিনে ও শেষ লেখার মধ্য দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে। শুধু কাব্যেই নয়— নাটক, প্রবন্ধ, রসরচনা, উপন্যাস, ছোটগল্প, সমালোচনা, শিশুসাহিত্য, বিজ্ঞান, সংগীত, ভ্রমণ কাহিনী প্রত্যেকটি বিভাগেই তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য বিহারের যোগফল হলো বাংলা সাহিত্যের বর্তমান চরম সমুন্নতি। এ পর্যায়ে তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো— গল্পগুচ্ছ, নৌকাডুবি, চোখের বালি, গোরা, যোগাযোগ, শেষের কবিতা, সাহিত্য, প্রাচীন সাহিত্য, আধুনিক সাহিত্য, সভ্যতার সংকট, বিচিত্র প্রবন্ধ, ছিন্নপত্র, রাশিয়ার চিঠি, ছেলেবেলা, কালান্তর, শিশু ভোলানাথ ইত্যাদি। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের জন্যে তিনি পেলেন ‘নোবেল পুরস্কার’ রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলেন বিশ্বকবি ।
রবীন্দ্র সংগীত : আশৈশব সংগীতে ছিল রবীন্দ্রনাথের অসামান্য পারদর্শিতা। আশৈশব সুকণ্ঠী কবি নিজের সংগীতে নিজেই সুর সংযোজনা করে ‘রবীন্দ্র সংগীতে’র একটি অনবদ্য ঐতিহ্যধারা সৃষ্টি করে যান। কথা ও সুরের এমন অন্বয় সম্মিলন সত্যিই বিরল দৃষ্ট। যতদিন পৃথিবীতে প্রেম, প্রকৃতি, ঈশ্বর চেতনা, স্বদেশ চেতনা থাকবে, ততদিন রবীন্দ্র সংগীতের আবেদন শেষ হবে না। রবীন্দ্র সংগীত নিখিল মানবজগতের তৃষিত চিত্তের তৃপ্তি সরোবর। তাঁর সংগীতের সংখ্যা যেমন বিপুল, তেমনি বৈচিত্র্যময়। ভারতের এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথেরই সৃষ্টি ।
নাটক ও অভিনয় : আবৃত্তি এবং অভিনয়েও তাঁর প্রতিভা আশ্চর্য দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে। স্বরচিত নাটকে স্বয়ং বিশিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মঞ্জগতে অভিনয়ের যে নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করে গেছেন, তা পরবর্তীকালে আমাদের নাটক এবং রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে ব্যর্থ হয়নি। শুধু তাই নয়, পরিণত বয়সে চিত্রশিল্পেও তিনি বিশ্বকে বিস্মিত করে দেন । তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো— প্রকৃতির প্রতিশোধ, রাজা ও রাণী, বিসর্জন, শারদোৎসব, চিরকুমার সভা, ফাল্গুনী, বসন্ত, রাজা, অচলায়তন, রক্তকরবী, ডাকঘর, মুক্তধারা, তাসের দেশ ইত্যাদি।
স্বদেশ ও সমাজ : স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষভাবে যোগদান না করলেও কবিতা, প্রবন্ধ ও সংগীতের মধ্য দিয়ে তিনি জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে এবং তার পরবর্তী সকল আন্দোলনে তিনি তাঁর কাব্যসাধনার অপূর্ব আলোকে প্রোজ্জ্বল করে গিয়েছেন জাতির একটি ঐতিহাসিক ঘটনা । স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে ।
বিশ্ব ভ্রমণ : রবীন্দ্রনাথ চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ, পারস্য, রাশিয়া— বিশ্বের যেখানে তিনি গেছেন, সেখানেই তিনি ভারতের বাণী বহন করে নিয়ে গেছেন। ভারতীয় জীবনধারা, ভারতের আধ্যাত্ম দর্শন এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বর্ণভাণ্ডারের প্রতি তিনি বিশ্বের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনীগুলো নিছক ভ্রমণকাহিনী মাত্র নয়। তাতে সুমুদ্রিত তাঁর ইতিহাস চেতনা, সময় সচেতনতা, অতলান্ত প্রজ্ঞাদৃষ্টি, মানবপ্রীতি এবং রসবোধের উজ্জ্বল পরিচয়। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণকাহিনীগুলো হলো— ইউরোপ যাত্রীর ডায়েরী, জাপান যাত্রীর পত্র, রাশিয়ার চিঠি, ছিন্নপত্র ও পারস্যে ইত্যাদি।
শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন : রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের কবিশ্রেষ্ঠরূপেই শ্রদ্ধার্থ। কিন্তু গঠনমূলক কাজেও রবীন্দ্র প্রতিভা বিস্ময়কর কৃতত্বের অধিকারী, তা অনেকের অজ্ঞাত। বীরভূম জেলার বোলপুরে ভারতীয় আদর্শে তিনি শান্তিনিকেতন’ নামে একটি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করে সেখানে স্বয়ং শিক্ষাদানে ব্রতী হন এবং কালক্রমে সেখানে ‘বিশ্বভারতী’ নামে এক বিরাট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । তাছাড়া রেখে যান যা কি না ছিল ভবিষ্যৎ ভারত গঠনের ইঙ্গিত শান্তিনিকেতনের অদূরে দেশীয় কৃষি ও শিল্পের উন্নতি বিধানের জন্য তিনি ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে।
মহাপ্রয়াণ : অবশেষে অম্লান মানবপ্রীতি, গভীর স্বদেশানুরাগ এবং রসপ্রগাঢ় উন্নত সাহিত্য সম্ভার পেছনে রেখে ২৫ বৈশাখের গৌরব সূর্য মহাকাশ পরিক্রমার শেষে ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮) কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি তাঁকে আবহমানকাল ধরে অমর করে রাখবে।
উপসংহার : রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলা সাহিত্য সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সংগীত প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক ও স্বদেশপ্রেমিক। বিজ্ঞানে তাঁর অপরিসীম আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে। এমনিভাবে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন সকল দেশের, সকল কালের মানুষের আদর্শ ও চেতনাসুদ্ধির প্রতিরূপ।
সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করছি আমাদের এই পোস্ট থেকে রচনা যেটি তুমি চাচ্ছিলে সেটি পেয়ে গিয়েছ। যদি তুমি আমাদেরকে কোন কিছু জানতে চাও বা এই রচনা নিয়ে যদি তোমার কোনো মতামত থাকে, তাহলে সেটি আমাদের কমেন্টে জানাতে পারো। আজকের পোস্টে এই পর্যন্তই, তুমি আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করে আমাদের বাকি পোস্ট গুলো দেখতে পারো।