রচনাঃ তোমার প্রিয় কবি

আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “তোমার প্রিয় কবি“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।

তোমার প্রিয় কবি

ভূমিকা : বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব উন্নত শির হিমাদ্রির মতো, বা ঊর্ধ্ব থেকে নিম্নে পতিত প্রবল শক্তিধর জলপ্রপাতের মতো। কারও কারও মতে, বাংলা সাহিত্যে তার উজ্জ্বল প্রবেশ যেন ধূমকেতু বা ঝঞ্ঝার মতই। বাংলা কাব্যের শান্ত সরোবরে সমুদ্রের তরঙ্গ সঞ্চারিত করেছেন তিনি । তাই বাঙালি পাঠকের কাছে তাঁর প্রধান পরিচয় বিদ্রোহী কবি নজরুল।

জন্ম ও পরিচয় : কাজী নজরুল ইসলাম ভারতের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ সালে) এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ফকির আহমদ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন। বাল্যকালেই নজরুল পিতৃহীন হন। ফলে তাঁকে আর্থিক কষ্টে পড়তে হয়। নজরুলের জীবনে তাঁর কাকা বজলে করিমের প্রভাব অপরিসীম। তাঁর বাল্যশিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যেত যদি না তিনি কাকার সহায়তা পেতেন ।

বাল্যশিক্ষা : নজরুলের জীবন বিচিত্র কর্মবহুল, সদাচঞ্চল, অভিনব এবং প্রতিভাদীপ্ত। অতি শৈশব থেকে তাঁর শিক্ষানুরাগের প্রকাশ এবং সে অনুরাগকে সার্থক করার বাসনায় তাঁর দেশান্তর গমন। তার আগে ১০ বছর বয়সে তিনি তাঁদের গ্রামের মক্তব হতে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় পাস করেন। তারপর তিনি রাণীগঞ্জের নিকটবর্তী শিয়ারশোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু স্বাধীনচেতা নজরুলের স্কুলের নিয়মকানুন পছন্দ হলো না। তিনি সেখান থেকে আসানসোলে পালিয়ে যান এবং এক রুটির দোকানে মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে কাজ করতে থাকেন। এ সময়ে ময়মনসিংহ জেলার কাজী রফিজউদ্দিন আসানসোলে দারোগা ছিলেন। তিনি নজরুলের চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি দেখে তাঁকে স্বগ্রামে নিয়ে যান এবং কাজীর সিমলা গ্রামের হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। সপ্তম শ্রেণিতে উঠে তিনি ভর্তি হন বর্ধমানের শিয়ারশোল রাজ বিদ্যালয়ে। এখানে ছাত্র হিসেবে তিনি বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর শ্রেণিতে তিনিই শ্রেষ্ঠ ছাত্রের মর্যাদা লাভ করেন। বার্ষিক পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তিনি একেবারে সপ্তম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে ওঠেন পরের বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে তিনি প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষাও দেন। কিন্তু তার পরেই ব্যক্তিগত কারণে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বিদায় গ্রহণ করেন এবং প্রথম মহাযুদ্ধে যোগ দেন।

Read More:  রচনাঃ বাংলাদেশের নকশিকাঁথা

বিচিত্র জীবন : বিচিত্র ও বহুমুখী জীবন যাপন করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর বয়স যখন মাত্র দশ বছর, তখন তিনি মক্তবে শিক্ষকতা করেছেন। তাতে বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় এ বয়সেই তিনি গ্রাম্য ‘লেটোর’ দলে যোগ দেন। লেটোর দলে যোগ দিয়ে তিনি অল্প বয়সেই গান ও নাটক লিখে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। নজরুল বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্র হয়েও সেখানকার প্রতিভাদীপ্ত ও উজ্জ্বল সম্ভাবনামুখর জীবনকে ছিন্নপত্রের মতো উড়িয়ে দিয়ে চলে গেছেন মৃত্যু সমাকীর্ণ রণক্ষেত্রে। যুদ্ধে তিনি সাধারণ সৈনিক (হাবিলদার) হয়ে যোগদান করেন। করাচিতে হেড কোয়ার্টার্সে তাঁর তিন বছর কাটে। যুদ্ধশেষে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে একত্রে বাস করতে থাকেন। সাম্যবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অনুপ্রেরণা সঞ্চার করেন। তাঁর সাম্যবাদী চিন্তা সর্বতোভাবে জীবনমুখী এবং উচ্ছ্বাসবহুল। প্রগতিশীল কিছু পত্রিকার সঙ্গেও তিনি যুক্ত হন। যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর নজরুল প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন। কিন্তু ঘরের মোহ তাঁর সদাচঞল জঙ্গম জীবনকে কোনোভাবেই রুদ্ধ করতে পারে নি। আশ্চর্য জীবনীশক্তি ও উদ্বেল যৌবন উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি বিদ্রোহীর মতোই জীবন যাপন করেছেন। ধূমকেতুর মতো নজরুল প্রবল আবেগে স্বরচিত গান গাইতে গাইতে বন্ধুদের সভায় হঠাৎ আবির্ভূত হতেন। সারা দেশকে যৌবনশক্তির বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন।

বিদ্রোহী নজরুল : বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে বিদ্রোহাত্মক কবিতা নিয়ে নজরুলের বাংলা সাহিত্যে দীপ্ত আবির্ভাব। কবির বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ‘মোসলেম ভারত’ নামক সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে সাড়া পড়ে যায়। সচেতন পাঠক অনুভব করেন, বাংলা সাহিত্যে একজন অভিনব ও অমিত শক্তিধর কবির আবির্ভাব হয়েছে। এই কবির কবিতায় ও গানে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিকীর্ণকারী বিদ্রোহ চেতনা, চিরাচরিতের শাসন নাশন বিপ্লবের আহ্বান। এর ফলে বাংলাদেশের পাঠক সাধারণের কাছে তিনি হলেন ‘বিদ্রোহী কবি’। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচার তাঁর কবিতাকে করে তুললো বিদ্রোহাত্মক, ভাষাকে বীর্যবান এবং প্রকাশভঙ্গিকে দীপ্ত। কবি তাঁর কবিতায় শুধু বিদেশি শক্তিকেই আঘাত করলেন না, নিজের দেশের অসাম্য এবং দুর্বলের প্রতি প্রবলের অত্যাচার ও অন্যায় আচরণকেও করলেন সমালোচনাবিদ্ধ। এসবের ফলে ইংরেজের কারাগারেও তাঁকে কিছুকাল কাটাতে হয়েছিল। কবির এই বিদ্রোহ চেতনাকে ধারণ করে রচিত হয়েছে তাঁর ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘শিকল ভাঙার গান’, ‘প্রলয় শিখা’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ।

Read More:  রচনাঃ একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ

প্রেম ও প্রকৃতির কবি গীতিকার নজরুল : বিদ্রোহী মনোভাবের বাইরে নজরুলের প্রেম ও প্রকৃতিনির্ভর কবিতা ও গানের সংখ্যা কম নয় । তাঁর প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক কবিতার সর্বাঙ্গ ব্যাপ্ত করে যে আবেগ, অনুভব ও হিল্লোল বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রোত্তর যুগে তাঁর সমধর্মী কবিতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া তাঁর ভক্তি সংগীতও কম নয়। কবির বিদ্রোহ চেতনার সঙ্গে প্রেম, প্রকৃতি চিন্তা ও ভক্তির সম্মিলন তাঁর কবিমানসকে সম্পূর্ণতা দিয়েছে। কবির উপর্যুক্ত বিশিষ্টতাগুলো প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘দোলন চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘চক্রবাক’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে ও শ্যামাসংগীত সংকলনে। কবি শিশু-কিশোরদেরও অবহেলা করেন নি। পরম ভালোবাসায় তাদের জন্য রচনা করেছেন ‘ঝিঙে ফুল’, কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো ।

নজরুলের অন্যান্য গ্রন্থ : কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রোত্তর কালের শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ সুরকার ও সংগীত রচয়িতা। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে সাম্যবাদী, সর্বহারা, সিন্ধু হিন্দোল, বুলবুল, চোখের চাতক, গীতি শতদল, পুবের হাওয়া, নতুন চাঁদ, রুবাইয়াৎ-ই- হাফিজ, রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম, বাঁধন হারা, ফণিমনসা, ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা, যুগবাণী, রাজবন্দীর জবানবন্দী, রুদ্রমঙ্গল, দুর্দিনের যাত্রী, ধূমকেতু প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

অসাম্প্রদায়িক নজরুল : কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক কবি। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এত বড় অসাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক মিলনের কবি বাংলা সাহিত্যে আর কেউ আছেন কি না সন্দেহ। তাঁর কবিতা ও সংগীত হিন্দু মুসলমান সংস্কৃতির মিলনাত্মক ঐক্যবদ্ধ ভারতের এমন এক নিবিড় উপলব্ধি সঞ্চার করে দেয়, যার তুল্য ভিন্নতর দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। সমালোচক আজহার উদ্দীন যথার্থই বলেছেন, “একদিকে হিন্দু সংস্কৃতির মনীষা, ত্যাগ ও তপস্যা, অপরদিকে মুসলিম সংস্কৃতির দুর্বার তেজ ও দুরন্ত সাহসের অপূর্ব মিশ্রণে যে দিব্যমানবত্বের সৃষ্টি হয়, কবি নজরুলের সাহিত্য সেই রসাদর্শের সাহিত্য।”

বাংলাদেশের জাতীয় কবি : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নজরুলের গান ও কবিতা বিপুল অনুপ্রেরণা যোগায় । ১৯৭২ সালে কবিকে ঢাকায় এনে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন দুরারোগ্য রোগ ভোগের পর এই মহান কবি ১৯৭৬ সালে ইন্তেকাল করেন । তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সামরিক ও জাতীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয় ।

Read More:  রচনাঃ শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটার

উপসংহার : কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা একদা বাংলা সাহিত্যে যে প্রবস উন্মাদনা ও প্রচণ্ড বিস্ফোরণ সৃষ্টি করেছিল, তার সম্পূর্ণ অবসান আজও হয় নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘বসন্তের অগ্রদূত’ বলে অভ্যর্থনা করেছিলেন। একথাও অসত্য নয়, নজরুলের কবিতার কঠোর প্রকাশভঙ্গি অনেক সময় তাঁর বিশিষ্টতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। আবার একথাও অনস্বীকার্য যে, তাঁর কবিচেতনার আন্তরিকতা ও উচ্চনিনাদী আঙ্গিক তাঁর কবিতাকে স্ফূর্ত প্রাণাবেগে পূর্ণ করেছে।

সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করছি আমাদের এই পোস্ট থেকে রচনা যেটি তুমি চাচ্ছিলে সেটি পেয়ে গিয়েছ। যদি তুমি আমাদেরকে কোন কিছু জানতে চাও বা এই রচনা নিয়ে যদি তোমার কোনো মতামত থাকে, তাহলে সেটি আমাদের কমেন্টে জানাতে পারো। আজকের পোস্টে এই পর্যন্তই, তুমি আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করে আমাদের বাকি পোস্ট গুলো দেখতে পারো।

Fahim Raihan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *